দুরন্ত গতিতে ছুটছে চিনের রফতানি বাণিজ্য। সম্প্রতি সেখানে এক লক্ষ কোটি ডলারের উদ্বৃত্তে পৌঁছে গিয়েছে বেজিং। এ-হেন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যচুক্তির রফাসূত্র বার করতে আগামী বছর (পড়ুন ২০২৬ সালে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কিন্তু, তার পরেও যাবতীয় ‘তুরুপের তাস’ তাঁর হাতে নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, উল্টে দাবার চালে সব হিসাব পাল্টে দিয়ে মান্দারিনভাষীদের আর্থিক সঙ্কটের মুখে ফেলতে পারে আমেরিকা। আর এর জন্য একমাত্র দায়ী হবে তাদের ‘দুর্বল’ ঘরোয়া অর্থনীতি।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী রয়েছে চিনের ঘরোয়া অর্থনীতির সূচক। দেশের মাটিতে উৎপাদিত পণ্য কেনার দিকে ড্রাগনবাসীদের তেমন কোনও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে ছোট-বড় সব ধরনের শিল্পে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় সেখানকার কারখানাগুলি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছে পণ্য উৎপাদন। এতে খুচরো বিক্রির বিষয়টি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে দিন দিন কমছে বিনিয়োগ।
বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে চিনা অর্থনীতিকে পুরোপুরি রফতানি নির্ভর বলা চলে। এর জেরে ঘরোয়া এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্ট হতে বসেছে। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত এতে সামঞ্জস্য আনতে না পারলে বিপদে পড়তে পারে প্রেসিডেন্ট শি-র সরকার। কারণ, বেজিঙের পণ্যে আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা চাপালে ভেঙে পড়তে পারে তাদের আর্থিক মডেল। জিনপিঙের এই ‘দুর্বলতা’কে কাজে লাগিয়ে ‘বড় দাঁও’ মারার সুযোগ যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাবেন, তা বলাই বাহুল্য।
চিনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকা শক্তি হল রিয়্যাল এস্টেট। কোভিড-পরবর্তী সময় (পড়ুন ২০২২ সালের পর) থেকেই এতে চরম মন্দা লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশের বড় বড় শহরগুলিতে হঠাৎ করে কমে গিয়েছে ফ্ল্যাট বা বাড়ি বিক্রির পরিমাণ। সরকারি স্তরে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা পড়তেই নড়েচড়ে বসে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার উপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে শুরু করে ড্রাগনভূমির একাধিক পুর প্রশাসন। তাতেও ছবিটা যে বিশেষ বদলেছে, এমনটা নয়।
সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৪ ডিসেম্বর বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার নিয়মে বিশেষ একটি ছাড় সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে চিনের একাধিক পুর প্রশাসন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হুকোউ’ নথি না থাকলেও বেজিঙের মতো রাজধানী শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন যে কোনও মান্দারিনভাষী নাগরিক। এক বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে আয়কর দিলেই এই যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন তাঁরা। আগে এর জন্য টানা দু’বছর ধরে আয়কর দেওয়ার নিয়ম ছিল সেখানে।
‘হুকোউ’কে চিনের একরকমের নাগরিকত্বের নথি বলা যেতে পারে। গ্রাম থেকে এসে বেজিঙের মতো রাজধানী শহরে পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য এটা দিয়ে থাকে ড্রাগনভূমির স্থানীয় প্রশাসন। বেজিঙের আর্থিক মডেল অনুযায়ী, এলাকাবাসীকে সুনির্দিষ্ট একটি জেলা বা অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অধিকাংশ বাসিন্দাই সেখানে কাজ পেয়ে যান। যদিও তার পরেও কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা, ব্যবসা বা অন্য কোনও কারণে বেজিঙের মতো রাজধানী শহরে এলে প্রয়োজন পড়ে ‘হুকোউ’ নথির।
এত দিন পর্যন্ত একাধিক সন্তান রয়েছে এমন পরিবারের বেজিংয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাট থাকলে, অতিরিক্ত বাড়ি কেনার অনুমতি দিত না শি সরকার। এ বার সেই নিয়মেও বড় বদল এনেছে চিনের প্রায় সমস্ত পুর প্রশাসন। সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, ওই ধরনের পরিবারগুলি অতিরিক্ত বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে। এই পদ্ধতিতে ঘরের মাটিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে চাঙ্গা রাখতে চাইছেন সিপিসির শীর্ষ নেতৃত্ব।
এ বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে খুচরো বিক্রি সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট হাতে পান শি সরকারের পদস্থ কর্তারা। রিপোর্ট দেখে চোখ কপালে ওঠে তাঁদের। প্রশাসনিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের নভেম্বরে ঘরোয়া বাজারে খুচরো বিক্রির মাত্রা মাত্র ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের পর এর গতি সবচেয়ে মন্থর বলা যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে একটা স্থবিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
চিনা ঘরোয়া অর্থনীতির এ-হেন খারাপ অবস্থার জন্য বিশ্লেষকেরা একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, কোভিড-পরবর্তী সময় থেকে কেবলমাত্র রফতানি পণ্যেই বিনিয়োগ পেয়েছে বেজিং। ঘরোয়া সামগ্রীর শিল্প সংস্থাগুলি লগ্নি টানতে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়ত, কোভিডের বছরগুলিতে আর্থিক সঙ্কট ড্রাগনভূমির আমজনতাকে অনেক বেশি সঞ্চয়ী করে তোলে। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকেন তাঁরা। উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার পরিমাণ।
বিশ্লেষকদের দাবি, আর্থিক বৃদ্ধির এ-হেন একমুখীতা বেজিঙের সামনে দু’টি সমস্যা তৈরি করতে পারে। প্রথমত, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে চিনের উপর বাড়বে ঋণের ভার। কারণ, ঘরোয়া শিল্পকে চাঙ্গা রাখতে রিয়েল এস্টেট-সহ একাধিক সংস্থাকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে শি সরকার। তারা সেই টাকা মেটাতে না পারলে জিনপিং প্রশাসনের সামনে নতুন করে ঋণ নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা থাকে না। দীর্ঘমেয়াদে সেই আর্থিক চাপ নেওয়া ড্রাগনের পক্ষে কঠিন।
দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট আর্থিক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ করতে পারে চিনা সরকার। তার আবার দ্বিমুখী সমস্যা রয়েছে। এর জন্য প্রথমেই সিপিসি থেকে অনুমতি নিতে হবে জিনপিং প্রশাসনকে। তা ছাড়া ১০ থেকে ১২ বছরের আগে আর্থিক সংস্কারের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। তত দিনে ভূ-রাজনীতির অনেক হিসাব যে বদলে যাবে তা ভালই জানেন প্রেসিডেন্ট শি।
ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় দর কষাকষিতে আরও একটি জায়গায় অসুবিধা আছে জিনপিঙের। ড্রাগনের ঘরোয়া বাজারে মার্কিন পণ্য বিক্রি করা যে কঠিন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমেরিকার বাজারে সহজেই ঢুকছে সস্তা দরের চৈনিক সামগ্রী। এ ব্যাপারে তাই চাপ তৈরি করতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাতে রফাসূত্র না বার হলে ফের উচ্চ হারে শুল্ক চাপানোর রাস্তায় হাঁটার তাস থাকছে তাঁরই হাতে।
এ ব্যাপারে আমেরিকাকে টেক্কা দিতে মার্কিন পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে পাল্টা চাপ তৈরির রাস্তায় যেতে পারেন জিনপিং। কিন্তু, তাতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। কারণ, চিনের বাজারে এমনিতেই বিপুল পরিমাণে সামগ্রী বিক্রি করতে পারছে না আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট শি তাই সরাসরি শুল্কযুদ্ধের দিকে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ম থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির উপর বেজিঙের সামগ্রী আমদানি হ্রাস করার জন্য চাপ তৈরি করতে পারেন ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মতো ব্রহ্মাস্ত্রও রয়েছে তাঁর হাতে।
ভারত এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলির সঙ্গেও চিনের বাণিজ্যিক ঘাটতির অঙ্ক আকাশছোঁয়া। নয়াদিল্লি ইতিমধ্যেই সেই সূচককে টেনে নামাতে ওমান, নিউ জ়িল্যান্ড বা ব্রিটেনের মতো দেশগুলির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলেছে। ডিসেম্বরে ভারত সফরে এসে মস্কোর ঘরোয়া বাজার এ দেশের পণ্যের জন্য খুলে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখে। এগুলি সবই বেজিঙের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
তা ছাড়া প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে জলের মতো টাকা খরচ করছেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই ধরনের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে ব্যুমেরাং হতে পারে। কারণ, উচ্চভিলাষী প্রকল্পগুলি অনেক বেশি গবেষণা নির্ভর। প্রতি বারই সেখানে ১০০ শতাংশ সাফল্য আসবে এমন নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া কোনও কারণে ওই ধরনের প্রকল্প বাতিল হলে বা বন্ধ করতে হলে জলে যায় কোটি কোটি টাকা। সেই ক্ষতি সামলানো যে কোনও দেশের পক্ষেই কঠিন।
জিনপিং সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির মধ্যে অন্যতম হল ঘরোয়া শিল্পে আর্থিক বরাদ্দ হ্রাস করা। সমালোচকেরা মনে করেন, বিদেশনীতির ব্যাপারে অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট শি। ফলে ঘর না বাঁচিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে চাইছেন তিনি। তা ছাড়া যে কোনও মূল্যে সাবেক ফরমোজ়া বা তাইওয়ানের (পড়ুন রিপাবলিক অফ চায়না) মূল ড্রাগনভূমির সঙ্গে সংযুক্তিকে প্রধান্য দিতে গিয়ে দেশীয় শিল্পকে প্রবল ঝুঁকির মুখে ফেলছেন তিনি।
তা ছাড়া তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে জাপান, রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিরুদ্ধে ক্রমশ পারদ চড়াচ্ছে চিন। পাশাপাশি ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম এমনকি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও সংঘাত রয়েছে বেজিঙের। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে গত কয়েক বছরে বিশাল ফৌজ তৈরি করেছে জিনপিং সরকার। সেনার জন্য খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ড্রাগনের বাজেটেও বেশ কিছু অসঙ্গতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
চিনের সঙ্গে রাশিয়ার মতো ‘বন্ধু’ দেশেরও সীমান্ত সংঘাত রয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) প্রায়ই আগ্রাসী মনোভাব দেখায় বেজিং। জিনপিঙের এই সমস্যাগুলির কথা মাথায় রেখেই তাঁর সঙ্গে দর কষাকষির অঙ্ক বাড়াতে পারেন ট্রাম্প। এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কে কাকে টেক্কা দেন সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।