ছবি: সৌমেন দাস।
পূর্বানুবৃত্তি: পানিহাটিতে প্রোমোটিংয়ের নতুন প্রজেক্ট শুরু হয়েছে দেবলের। সেখানেই পল্লবীকে সাতশো স্কোয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট দেবে বলে ডেকে পাঠায় দেবল। সেখানে পল্লবী গিয়ে পৌঁছলে, নির্জনতায় পল্লবীর থেকে ইচ্ছেমতো শরীরী সুখ আদায় করে নেয় দেবল। ফ্ল্যাটের মোহে কোনও আপত্তি না করে সব রকম ভাবে দেবলকে তৃপ্ত করে পল্লবী। তবু সব কিছুর শেষে বাড়ি ফিরে সন্তানের মুখোমুখি হতে অপরাধবোধ উঁকি দেয় তার মনে। অন্য দিকে জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ড্রাইভার সাধন। কিন্তু তিনি তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি বলে বাইরে বসে বাঁশিতে দরবারি কানাড়ার সুর তোলে সে। সেই সুর শুনে ঘুম ভাঙে জ্যোৎস্নাদেবীর। তিনি তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের নানা কাহিনি শোনান সাধনকে। তার কিছু ক্ষণ আগেই ছেলে দীপকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে বিষ্ণুপুরের পথে রওনা হয়েছেন দীপঙ্কর।
পল্লবী নাকি খুন হয়ে যেতে পারে অকালে, কিংবা আত্মঘাতিনী, এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ।
কিন্তু পল্লবীর ধারণা, এ সব শুধুই বাগাড়ম্বর। আসল হচ্ছে ডলার। শেয়ার মার্কেটের কামানের শব্দ বাঁশির চেয়েও মন কেমন করা। টাকা, টাকা, টাকা! পৃথিবী টাকার বশ। এক দিন হাজার হাজার পুরুষ পল্লবীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে। জীবনটাকে ভোগ করবে পল্লবী। ফ্ল্যাট দিয়ে শুরু হল। তার পর চাই আরও, আরও টাকা। এখান থেকেই হয়তো নতুন দেবলদের দেখা পাওয়া যাবে। পল্লবীর ক্যাপিটাল শরীর। এটাকে ভাঙালেই পয়সা। প্রচুর, প্রচুর চাই তার।
ভাবতে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল পল্লবী। প্রতিবিম্বকে প্রশ্ন করল, “আমি কি উন্মাদিনী?”
সে দেখতে পেল, তার গালের নরম অংশটা কেঁপে কেঁপে উঠল। এটা কি নিউরোলজিক্যাল প্রবলেম? ওষুধ খেতে হবে তাকে!
যদি দেবল তাকে ঠকায়! যদি আদালতে যেতে হয়! কী বলবে পল্লবী! তার তো দাবি করার কোনও অধিকার নেই। এটা ঠিক, দেবল তাকে ভোগ করেছে। ডিএনএ টেস্ট করলে ধরা পড়বে দেবল। প্রচুর ছবি, ভিডিয়ো রয়েছে পল্লবীর কাছে। এ সব দেবল জানে। ভালবাসা না-ই বা হল, সম্মান হারানোর ভয়ে দেবল সব দেবে।
একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করল পল্লবী আবার। ঘুম এল না। বিছানায় কিছু ক্ষণ এ দিক-ও দিক করল। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না।
গাড়ি এসে থামল জ্যোৎস্নাদেবীর দরজার সামনে। দীপঙ্কর ডাকলেন, “মা।”
জ্যোৎস্নাদেবীর স্বপ্নে এই ডাকটা প্রায় থাকে।
একটু আগে বসে ভাবছিলেন, উনি যখন প্রথম এলেন, চিৎপুরে ফড়ের দল মজলিশ করছে। ওঁকে দেখে তাচ্ছিল্য করে বলল, “আজও এয়েচেন! কোনও কামাই নেই গো আপনার। আপনার বদনে নায়িকা পাওয়া দায়!”
এ সব উনি পরে বলেছিলেন।
এই সময় এক জন বেরিয়ে এসে বললেন, “আসুন গদিতে। আপনার নায়িকাও নবাগতা। মনে হচ্ছে যাত্রায় দু’জনকে মানাবে ভাল।”
দেখলেন মুখ তুলে, কী সুন্দর পুরুষ! পৃথিবী এক বার পায় তারে, আর পায় নাকো।
প্রথম যাত্রায় সফল তাঁরা। নাম যেন কী ছিল, এখনই মনে পড়ছে না।
দীপঙ্কর কিছুটা বাবার মতো, সবটা নয়। কিন্তু সঙ্গে এই কিশোর ছেলেটি কে!
দীপঙ্কর বললেন, “যাও, ঠাম্মাকে প্রণাম করো।”
দীপ প্রণাম করলে তিনি বুকে টেনে নেন।
দীপঙ্কর এ বার বললেন, “মা, তাড়াতাড়ি চলো, যেতে হবে গুপ্ত বৃন্দাবন।”
“বৃন্দাবন যাব! কেন!”
“ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, গুপ্ত বৃন্দাবন। রাতে থাকবে। ফিরতে ফিরতে পরশু দিন। এই বৃন্দাবন হল বাঁকুড়ার বুকে বিষ্ণুপুর। এক সময় মল্লরাজাদের রাজ্যপাট ছিল।”
জ্যোৎস্নাদেবী দীপের চিবুক ধরে বললেন, “একেবারে দীপঙ্কর যেন! তোমার বাবার মতো হয়েছ। দাঁড়াও আসছি।”
“দেরি করলে হবে না কিন্তু।”
“এই আসছি,” বলে কিছু ক্ষণ পরে এলেন। হাতে একটা আংটি।
দীপের অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, “তেমন কিছু নেই আমার। সোনা দিয়ে মুখ দেখলাম সোনার নাতির।”
দীপ বলল, “ঠাম্মা, অনেক গল্প শুনব কিন্তু!”
“নিশ্চয়ই বাবা। অনেক গল্প আছে।”
তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হলেন। জামাকাপড় নিলেন।
এর পর বললেন, “টাকা তেমন নেওয়া হল না।”
“কিছু দরকার নেই, তুমি চলো।”
সাধন এ সব দেখে কখন নিঃশব্দে চলে গেছে।
গাড়িতে উঠে নাতির পাশে বসে মন ভরে গেল। বললেন, “একটা পুরনো গান গাইব, শুনবে দীপ!”
দীপ বলল, “ঠাম্মা আমি যে দীপ, তুমি জানলে কী করে?”
থুতনি ধরে আদর করে বললেন, “ঠাম্মাদের জানতে হয়, বাবা!”
দীপঙ্কর বললেন, “মা, গাও।”
সামান্য গলাটা ঝেড়ে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন দরবারি কানাড়ায়, “শিবজটারাজিত দেবী গঙ্গে...”
কত দিন পর গান শুনছে দীপ। বাড়িতে শুধু মায়ের টাকার গল্প।
দীপঙ্কর বললেন, “মা, কখনও বিষ্ণুপুর গেছ!”
“যাত্রা করতে বাঁকুড়া গেছি, বিষ্ণুপুর যাইনি।”
দীপঙ্কর ফোন করলেন জনমেজয়বাবুকে, “নিয়ে আসছি এক জনকে। আপনি তো চমকে যাবেন। তবে ফিস্ট খাওয়া হবে না, রাস্তায় খেয়ে নেব। আর টাকাটা দিয়ে দেব।”
“সে বলতে হবে না, আপনাকে আমি জানি। মা আসছেন তো! বুঝে গেছি। অপেক্ষায় রইলাম।”
দীপ বলল, “বাবা, গল্প বলো।”
“ঠাকুরমা আমার চেয়ে বেশি গল্প জানেন।”
দীপ বলল, “ঠাম্মা, বলো!”
জ্যোৎস্নাদেবী শুরু করলেন, “সে ছিল এক দেশ। রহস্যে মোড়া এক রাজ্য, নাম মল্লভূমি। অনেকে আক্রমণ করতে এসে ফিরে যেতেন। সে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি হোক, কিংবা বর্গি সর্দার ভাস্কর পণ্ডিত।”
“কেন! প্রচুর সৈন্য ছিল রাজাদের?”
“তা তো ছিলই, আর ছিল সব পরিখা। সাতটা বাঁধ রাজ্যকে শত্রুর থেকে আলাদা করে রাখত। কয়েকটা নাম জানি, যেমন লাল বাঁধ, যমুনা বাঁধ— এ রকম সব নাম।”
দীপ বলল, “আচ্ছা ঠাম্মা, শুধুই বাঁধ?”
“না, আর ছিল দলমাদল কামান। একে শত্রু আটকে যেত, পরিখা পেরোতে পারত না, তার উপর দলমাদল থেকে গোলা বর্ষিত হত। ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত সৈন্যদল। এর পর এল এক রাজা, খুব বড় বীর। নাম বীর হাম্বির। তিনি আবার ডাকাতিও করতেন। রাজ্যের কর ফাঁকি দিয়ে যারা পালাত, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন বীর হাম্বির। কিন্তু যারা বাণিজ্য কর দিত, রাজা তাদের সুরক্ষা দিতেন।”
“দারুণ তো!”
জ্যোৎস্নাদেবী আঁচল দিয়ে দীপের মুখটা মুছিয়ে দিলেন, কয়েকটি চকলেট বের করে হাতে দিলেন। দীপ আবার বাবা, ঠাম্মা আর ড্রাইভারকাকুর মধ্যে ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্যও রাখল। একটা চকলেট মুখে দিয়ে বলল, “তার পর বীর রাজা হাম্বির কী করল?”
জ্যোৎস্নাদেবী নিজের মুখটা একটু মুছে নিলেন। একটা ভ্যাপসা গরম ভাব আছে।
দীপঙ্কর বললেন, “মা, এসি চালাই?”
“দরকার নেই, বাইরেটা দেখতে বেশ লাগে।”
দীপ বলল, “ঠাম্মা, তুমি এত সব গল্প জানলে কী করে?”
“কিছু বই পড়ে, আর অনেকটা তোমার দাদুর কাছে গল্প শুনে।”
“দাদু বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ, তিনি এসেছিলেন। তখন জঙ্গল কেটে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট হচ্ছে। কিছু চিতাবাঘও দলছুট হয়ে চলে আসত লোকালয়ে!”
দীপ বলল, “বীর হাম্বির কী করতেন তা হলে?”
“সেই সময় তো পুরোটাই অরণ্য। রাজা কত বাঘ মেরেছেন, তার হিসেব আছে! তখন তো এ সব নিষিদ্ধও ছিল না। যখন দেশ স্বাধীন হল, তারও বহু বছর পর... তখন তো আর রাজা নেই, সেই অরণ্যও নেই। প্রচুর গাছ কেটে জনবসতি তৈরি হয়েছে।”
দীপ বলল, “ঠাম্মা, বীর হাম্বিরের কথা বলো।”
“বলছি বাবা, একটু জল খেয়ে নিই।”
দীপ জলের বোতলের ঢাকনা খুলে ঠাম্মার দিকে এগিয়ে দিল।
দীপঙ্কর বললেন, “রাজপরিবার এখন বিলীন হয়ে গেছে। গুমঘর, দলমাদল কামান, তোরণদ্বার, ভগ্ন রাজপ্রাসাদ রয়ে গেছে শুধু।”
দীপ অস্থির হয়ে বলল, “ঠাম্মা, বীর হাম্বির।”
জ্যোৎস্নাদেবী আবার বলতে শুরু করলেন। গাড়ি সামান্য জ্যামে পড়ল। তখন জানলার কাচ তুলে এসি চালিয়ে দেওয়া হল। এ বার জ্যোৎস্নাদেবী বলতে শুরু করলেন, “বীর হাম্বির দেখতেন, রাজকর্মচারীরা ঠিকঠাক কাজ করছে কি না! কোনও বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে না তো! এক বার অশ্বারোহণে যেতে যেতে অন্ধকারে মনে হল, কিছু যেন ছুটে আসছে। রাজা হাঁক দিলেন, ‘কে?’ একটি অশ্বেতর। তার পৃষ্ঠে এক রমণী। ধীরে ধীরে আসছেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি?’ উত্তর নেই। মূর্তি নিরুত্তর। ফের প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি, এত রাতে?’ কোনও উত্তর এল না।”
দীপ বলল, “তার পর?”
“রাজা তো অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। একের পর এক। কিচ্ছু হল না। রাজা এবার মা মৃন্ময়ীকে স্মরণ করলেন। তখন দৈববাণী হল, ‘মূর্খ! আমিই দেবী মৃন্ময়ী। মহামারি প্রতিরোধের জন্য রাজ্যে ভ্রমণ করি।’ তার পর আরও সব কথা আছে, বিষ্ণুপুরে মা মৃন্ময়ীর মন্দির স্থাপিত হল। দেখার অধিকার শুধু রাজার আর পুরোহিতের।”
দীপ বলল, “এখন?”
“রাজতন্ত্র আর নেই, এসেছে গণতন্ত্র। মন্দির এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। আমরা মৃন্ময়ীর মন্দির দিয়ে শুরু করব। আরও অনেক কিছু আছে, দলমাদল কামান, মদনমোহন মন্দির, লালবাই। তোমাকে লালবাইয়ের কথা বাবা বলবে, যদি মনে করে।”
দীপঙ্কর বললেন, “সবটা জানা দরকার। দীপ তো বড় হচ্ছে।”
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “দাদুভাই, গল্প বলতেন তোমার দাদু। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত সকলে। তোমাকে আর একটা গল্প বলি, মাছের রাজকুমারের গল্প...”
আরামবাগ চলে এল।
দীপঙ্কর বললেন, “এ বার তো খেতে হবে মা!”
দীপ বলল, “না, আগে ঠাম্মার গল্পটা শুনি।”
“চলো বাবা, তোমার পিত্ত পড়ে যাবে, খাবার দেওয়ার আগেই গল্পটা শোনাব।”
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “আমি কিন্তু নিরামিষ।”
দীপঙ্কর বললেন, “কেন মা?”
“আজ ছেলে আর নাতিকে পেয়েছি না, এখন থেকে নিরামিষই খাব। তোমরা মাছ বা মাংস খাও।”
হাত ধুয়ে দীপ বলল, “গল্পটা বলো ঠাম্মা।”
তিনি শুরু করলেন, “সে বার পাথরপ্রতিমায় যাত্রা করতে গেছি। যাত্রা হয়ে যাওয়ার পরের দিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। কালনাগিনী নদী উত্তাল। জামশেদ মিঞা ছিলেন প্রধান। তাঁর আহ্বানে আমরা গেছিলাম শো করতে। তিনি বললেন, ‘আপনারা আমার কোঠাবাড়িতে বিশ্রাম করুন, ঝড় থামলে যাবেন।’
“বিকেলের দিকে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করল। আমরা ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি।
“হঠাৎ জামশেদ মিঞা বললেন, ‘নীলতিমি কালনাগিনীতে ধরা পড়েছে। দেখবেন চলুন।’”
দীপ বলল, “তার পর!”
“আমরা গেলাম। শুক্লপক্ষের রাত কিংবা অস্পষ্ট চাঁদের আলো। আকাশে নক্ষত্রের মেলা বসেছে, আর গ্রামের মানুষ লণ্ঠন হাতে নিয়ে চলেছে নীল তিমি দেখতে। হাট বসে গেছে রীতিমতো। কাছে গেলাম যখন, বেশ গন্ধ ছাড়ছে। মাছে পচন ধরেছে। একদম সামনে এলাম, দেখলাম সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য! মাছেদের রাজকুমার শুয়ে রয়েছে। বিরাট লম্বা-চওড়া। ওরা বলেছিল সাড়ে ষোলো ফুট লম্বা, তেরো ফুট চওড়া। চাঁদের আবছা আলোয় একেবারে যেন নীল রাজকুমার। তোমার দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালনাগিনীতে এই মাছ এল কী করে?’ এক জন বলল, ‘সমুদ্রে জেলেরা জালে পেয়েছিল, পরে ভয়ে কালনাগিনীতে ছেড়ে গেছে গেছে।’”
দীপঙ্কর বললেন, “ওটা কি নীলতিমিই ছিল?”
“হাঙরও হতে পারে। তখনও মৎস্য দফতর আসেনি। সেই রাতে জামশেদ আমাকে আর তোমার বাবাকে আসতে দিলেন না।”
দীপ বলল, “জিয়ো ঠাম্মা! এ রকম গল্প আরও অনেক বলবে।”
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “খেয়ে নাও বাবা। ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
অপেরা হাউস-কাম-ক্লাবঘর-কাম রিহার্সালের কক্ষ জমে উঠল পানসদার আবির্ভাবে। তিনি উদাত্ত গলায় ডাকছিলেন, “ভূতনাথ, ভূতনাথ!”
জনমেজয় বললেন, “পানসদা, এখানে ভূতনাথ বলে তো কেউ নেই।”
পানসদা বললেন, “ভুলে গেলে উৎপল দত্তের ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’! ভূতনাথ গ্রামের তালুক চালাতেন। প্রফুল্লমণি দেবী চৌধুরানী।”
জনমেজয় বললেন, “দারুণ, আপনি সব সময় চমকে দেন।”
এ বার পানসদা বললেন, “‘ম্যাকবেথ’ করব আমরা, কিন্তু তার আগে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমাদের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ভুললে চলবে না।”
“নিশ্চয়ই, কিন্তু কী ভাবে?”
“আজ আমরা সংক্ষিপ্ত ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’র সংলাপ নিজের মতো বলে যাব, তবে মূল নাটককে বিকৃত না করে।”
ফটিক পাশ থেকে বলল, “মাথাটা গেছে!”
পানসদা বললেন, “এই ফটকে হতচ্ছাড়া, তুই কী বললি রে!”
পানসদা এ বার নাটকের রেনাল সাহেবের মতো চুরুট ধরালেন, “মিস্টার হেস্টিংস, যিনি খাজনা মেটাচ্ছেন, সেই রানিকে উচ্ছেদ করবেন!”
হেস্টিংসের সংলাপ নিলেন জনমেজয়, “সে দুশ্চরিত্রা। স্বামী কোম্পানির চাকর। আর বৌ চালাচ্ছে জমিদারি। হিন্দুরা নারী স্বাধীনতা মানে না। সেই চরিত্রের সংশোধন। রেক্টিফিকেশন।”
পানসদা বা রেনাল সাহেব বললেন, “বাঙালিরা নেটিভরা তো পশুর মতো মরছে। বেঙ্গল ফেমিন।”
“হু টোল্ড! জিসাস এশীয়দের জন্য নন,” হেস্টিংস বললেন।
ফটিকের দিকে তাকিয়ে পানসদা বললেন, “তুই ইংরেজদের বুট-চাটা শশাঙ্ক জমিদার।”
ফটিক বা শশাঙ্ক বলল, “হুজুর, সে কিন্তু ভয়ঙ্করী। সহজে ছাড়বে না।”
“কত উইচকে জব্দ করিয়াছি। রেনাল, তুমি শশাঙ্ককে লইয়া ফোর্ট উইলিয়াম যাইবে, ব্রজেশকে তছরুপের দায়ে গ্রেপ্তার করিবে।”
রেনাল বললেন, “নো নো। আমি আফিং সেবন করিয়াছি, মাথার ঠিক নাই। ভুলভাল লোককে টার্গেট করিব।”
হেস্টিংস বলে উঠলেন, “তবে তোমার কোর্ট মার্শাল হইবে।”
এই সময় সিনিয়র অ্যাক্টর সুধাংশুদা ঢুকলেন, গান গাইতে গাইতে, “আজ ধানের খেতে/ সাহেব চাবুক মারে/ নিরন্ন ক্ষুধিত চাষি/ রক্তাক্ত শরীর/ আর্তনাদে ফেটে পড়ে রাগে শতবার...”
রেনাল বললেন, “পুরো দেশটা বিদ্রোহী। সন্ন্যাসীর দল কোম্পানির কুঠি আর আমাদের পেটোয়া জমিদারদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে।”
সুধাংশুদা রামানন্দ বিদ্রোহীর গলায় বলতে শুরু করলেন, “কোনটা যুদ্ধ আর কোনটা যুদ্ধের বাইরে আমি জানি না। বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গুলিতে ক্ষুধিতের অশ্রুকণা। এ দেশ আজ যুদ্ধক্ষেত্র।”
পানসদা বললেন, “ব্রেভো সুধাংশু!”
“হেস্টিংস, বাঙালি জাতটা সাঙ্ঘাতিক। বেশির ভাগই দেবী চৌধুরাণী আর সন্ন্যাসী রামানন্দ।”
সন্ন্যাসীরা সশস্ত্র। এবার মরণের কূপে আত্মবলিদান। সকলে মিলে গাইতে থাকল, “ঘন গর্জন, ডাকে শত্রুর কামান/ আমরা চলেছি শুনে তার আহ্বান॥”
পানসদা ডাকলেন, “ভজা, আজ সবার জন্য মোটা ভূতমুড়ি চালের খিচুড়ি। মনে স্বদেশিয়ানা জাগাতে হবে।”
॥ ২২ ॥
পল্লবী জাগল যখন, তখন প্রায় রাত আটটা। রান্নাঘরে গিয়ে ভাত বসাল। ডিম সেদ্ধ করতে দিয়ে দিল। মাখনও আছে। ভাতে প্রচুর নুন খায় পল্লবী। গল ব্লাডার আর অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন হয়েছে, ইউটেরাসে টিউমারও ডেভলপ করেছে, তবে ম্যালিগন্যান্ট নয়। ডিমটা একটু বেশি খাওয়া হয়। দীপঙ্করকে কিছুটা রান্না শিখিয়েছে বারবার নার্সিং হোমে যাওয়ার আগে। এখন কিছুটা পারে। আগে পারত না। ওরা কোথায় কে জানে! আজ রাতে ফিরবে না বলেছে। শুনে বেশ খুশি হয়েছিল, কিন্তু এখন ভাল লাগছে না। খুব একা লাগছে, ভয় করছে।
এই সময় মোবাইলে রিং হল। স্ক্রিনে এক ভদ্রমহিলার নাম ভেসে উঠল। কে!
ও পার থেকে উত্তর এল, “আমি দেবলের স্ত্রী।”
পল্লবী নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ বলুন।”
“আপনি দেবলের কাছে ফ্ল্যাট দাবি করছেন?”
“না, ও ভালবেসে দেবে বলেছে।”
“এত ভালবাসা, জানতাম না তো!”
পল্লবী চুপ করে থাকে।
“ডকুমেন্টস কী আছে?”
পল্লবী বলল, “মানে?”
মানে, প্রমাণ। ওর সঙ্গে শোয়ার ভিডিয়ো আছে? নাকি আরও বেশি কিছু আছে?”
“এরকম কথা বলছেন কেন! আমি নোংরা মেয়ে নই। ঘরের বৌ।”
“আপনার হাজ়ব্যান্ডের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। একটু বেশি ভালমানুষ। আপনাকে ভয় করে। আপনি যে চতুর, এই নিয়ে আমার কোনও ডাউট নেই। অনেক কিছু আপনার কাছে থাকতে পারে। বাট আই ডোন্ট বদার।”
পল্লবী বলে, “আমার হাজ়ব্যান্ড বলেছে, আপনি ওঁকে বলেছেন।”
“তার পরও সমানে চলছে এসব! আবার বলছেন, আপনি নোংরা মেয়ে নন! সমাজ বদলেছে জানি, কিন্তু আমি বদলাইনি। আমার পারিবারিক শিক্ষা অন্য রকম।”
পল্লবী বলল, “আমি কি রাখব এবার ফোনটা?”
“বিয়ে না করে বিরাট চাকরি করছে, প্রচুর সেক্স এনজয় করছে, ভ্যাজাইনা দিয়ে রক্তটক্ত পড়ে তার পর ইউটেরাসে ক্যানসার নিয়ে মারা যায়— এসব কেস প্রচুর আছে, কিন্তু আপনি তো অত্যন্ত লো প্রোফাইল একজন মহিলা, শরীর ছাড়া আর কিছু নেই। তাও দেবলের কাছে পুরনো হয়ে এল। যাই হোক, ফ্ল্যাটের আশা ছাড়ুন।”
পল্লবী বলল, “ও তো আমাকে একটা কাগজে সই করাল।”
“ওসব দেবলের ঢ্যামনামি। ওকে আমি দেখে নেব। এই পাড়ায় আর দেখলে... অঞ্জন দত্তর গানটা জানেন তো?”
“ঠ্যাং ভেঙে দেবেন।”
“এটুকু ফোনে বললাম আপনার ভালর জন্য। আসলে আপনার হাজ়ব্যান্ড আর ছেলেটার জন্য। আমারও মেয়েরা রয়েছে। দুই মেয়ে। ওদেরও তো এসব কেচ্ছা জানলে খারাপ লাগবে। আমার জীবন থেকে সরে দাঁড়ান।”
“আপনাদের তো এত আছে, একটা ফ্ল্যাট দিলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“ঘরের বৌ সেজে বেশ্যাবৃত্তি কত দিন চালাবি! লাইনে গিয়ে দাঁড়া! অনেক ফ্ল্যাট, গাড়ি হয়ে যাবে।”
“আপনি এক জন শিক্ষিতা, ভাল চাকরি করেন, এত খারাপ কথা বলছেন!”
“খারাপের কিছুই তো হয়নি। কথাটা মনে থাকে যেন!” ফোন কেটে দিল দেবলের বৌ।
ক্রমশ