India VS England Test Series

২-২! হারের মুখ থেকে ৬ রানে জিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ় ড্র সিরাজের ভারতের, নাটকীয় সিরিজ়ের মহানাটকীয় সমাপ্তি

হাল ছাড়েনি ভারত। প্রতিটা রানের জন্য লড়েছে। শেষ পর্যন্ত জিতেছে। সেই লড়াইয়ে ভারত পাশে পেয়েছে সমর্থকদেরও। ওভালের গ্যালারি দেখে মনে হল, ইংল্যান্ডে নয়, ভারতেই খেলছেন শুভমন গিলেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৫ ১৬:২৬
cricket

জয়ের উল্লাস। ওভালে ভারতকে জিতিয়ে নায়ক মহম্মদ সিরাজ। ছবি: রয়টার্স।

“আপনি যদি এই খেলা না দেখেন, তা হলে আপনি খেলা ভালবাসেন না।” ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে বলছিলেন হর্ষ ভোগলে। সত্যি, শেষ কবে এমন টেস্ট দেখা গিয়েছে, তা মনে করা যাচ্ছে না। এ ভাবেও যে ভারত ফিরবে তা ভাবা কঠিন ছিল। সেই কঠিন কাজটাই সহজ করলেন মহম্মদ সিরাজ। ৫ উইকেট নিয়ে দলকে জেতালেন। সোমবার ৫৭ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। একটা করে উইকেট পড়ছিল আর হৃদ্‌স্পন্দন বাড়ছিল। এই সিরিজ় সিরাজের। প্রায় ১২০০ বল করেছেন। সবচেয়ে বেশি ২৩ উইকেট নিয়েছেন। দু’দল মিলিয়ে তিনিই একমাত্র পেসার যিনি পাঁচটা ম্যাচই খেলেছেন। শেষ দিন যখন একটা একটা রান করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে ইংল্যান্ড তখনও হাল ছাড়েননি তিনি। তাঁর বলে গাস অ্যাটকিনসনের স্টাম্প উড়ে যাওয়ার পরে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উল্লাস দেখা গেল। তার পর দু’হাত ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন সিরাজ। তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন বাকিরা। তত ক্ষণে অসাধ্যসাধন করে ফেলেছে ভারত। নাটকীয় সিরিজ়ের মহানাটকীয় সমাপ্তি হয়েছে।

Advertisement

পঞ্চম দিন পরিসংখ্যান স্পষ্ট ছিল। ওভালে টেস্ট ও সেই সঙ্গে সিরিজ় জিততে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৩৫ রান। টেস্ট জিতে সিরিজ় ড্র করতে ভারতের দরকার ছিল ৪ উইকেট। শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করল ভারত। পিছিয়ে থেকেও সিরিজ় ড্র করল তারা। মহম্মদ সিরাজ, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ ও আকাশদীপ বুঝিয়ে দিলেন, ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা। সেখানে শেষ বল না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। ওভালে নাটকীয় সিরিজ়ের নাটকীয় সমাপ্তি হল। ১-৩ সিরিজ়ে হারের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ২-২ সিরিজ় ড্র করলেন শুভমন গিলেরা। ইংল্যান্ডের মাটিতে পর পর দুটো সিরিজ় ২-২ ড্র করল ভারত। কোচ হিসাবে টেস্ট সিরিজ় হারের লজ্জা থেকেও বাঁচলেন গৌতম গম্ভীর।

cricket

ওভালে পঞ্চম দিনের খেলার স্কোরকার্ড। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সিরিজ় জিততে না পারলেও লড়াই করেছে ভারত। হেডিংলে ও লর্ডসে ভারত জিততে পারত। এই সিরিজ়ে ভারতের প্রাপ্তি অনেক। ব্যাট হাতে অধিনায়ক শুভমনের ফর্ম। বল হাতে সিরাজের ধারাবাহিকতা। উইকেটরক্ষক ঋষভ পন্থের ফর্মে ফেরা। এজবাস্টনে আকাশদীপের বোলিং। রবীন্দ্র জাডেজা ও ওয়াশিংটন সুন্দরের ব্যাট হাতে ছন্দ। ম্যাঞ্চেস্টারে প্রায় দু’দিন ব্যাট করে ভারতের ম্যাচ বাঁচানোও সেই তালিকায় থাকবে। সিরিজ়ে ৩১টা সেশন জিতেছে ভারত। ইংল্যান্ড জিতেছে ২২টা। কিন্তু তার পরেও সিরিজ় জিততে পারেনি ভারত। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভুল করেছে তারা। সেখানেই খেলার রাশ উল্টোদিকে চলে গিয়েছে। নইলে ইংল্যান্ডকে তাদের মাটিতে ৪-০ হারানোর সম্ভাবনা ছিল। গোটা সিরিজ়ে লড়াই করলেও জিততে পারল না ভারত। অবশ্য মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়বেন শুভমনেরা। গত দুই টেস্ট সিরিজ়ে যে লড়াই ভারতের খেলায় দেখা যায়নি, সেটা দেখিয়েছেন তাঁরা।

ওভালে চতুর্থ দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগে এগিয়ে ছিল ভারত। ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য দরকার ছিল আরও ৩২৪ রান। ভারতের প্রয়োজন ছিল ৮ উইকেট। সবুজ উইকেটে ৩২৪ রান কম নয়। দিনের শুরুটাও খারাপ হয়নি ভারতের। প্রথম সেশনে বেন ডাকেট ও ওলি পোপ আউট হয়ে যান। তখন ইংল্যান্ডের রান ১০৬। অর্থাৎ, জিততে দরকার আরও ২৬৮ রান। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ ও মহম্মদ সিরাজ ছন্দে ছিলেন। সেই সময় আর একটা উইকেট পড়লে খেলার রাশ অনেকটাই ভারতের হাতে চলে আসত।

সুযোগ তৈরিও করেছিলেন প্রসিদ্ধ। তাঁর একটা বলে পুল মারার চেষ্টা করেন ব্রুক। ব্যাটের কানায় লেগে বল হাওয়ায় ওঠে। প্রসিদ্ধ তখনই দু’হাত উপরে তোলেন। উল্লাস শুরুও করে দিয়েছিলেন তিনি। বলের নীচে দাঁড়িয়ে সিরাজ। বাউন্ডারির থেকে অনেকটাই আগে ছিলেন তিনি। কিন্তু সিরাজ বুঝতেই পারেননি বাউন্ডারির দড়ি ঠিক কোথায়। তিনি ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকেন। ক্যাচ ধরে আরও এক পা পিছোন তিনি। তাতে বাউন্ডারির বাইরে চলে যান সিরাজ। এক বার জীবন পাওয়ার পর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করলেন ব্রুক। একের পর এক বড় শট মারার শুরু করলেন তিনি। এই প্রতি-আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেলল ভারত। দেখে মনে হচ্ছিল, সিরাজের ভুলের খেসারত দিতে হবে ভারতকে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

গোটা সিরিজ়ে বুক চিতিয়ে লড়েছেন সিরাজ। দু’দলের বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওভার বল করেছেন। সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন। যখনই মাঠে নেমেছেন, নিজের ১০০ নয়, ২০০ শতাংশ দিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও ওভালে হারলে হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না ভারতীয় বোলার। ব্রুকের ক্যাচটা ধরতে পারলে অনেক আগেই ম্যাচটা জিতে যেতে পারত ভারত। তবে শেষ পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন সিরাজ। শেষ হাসি হেসেছেন তিনিই। কী অদ্ভুত সমাপতন। লর্ডসে অনেক লড়েও জেতাতে পারেননি সিরাজ। বোল্ড হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন। সেই সিরাজই ওভালে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন।

ব্রুক চালিয়ে খেললেও অন্য প্রান্তে ঠান্ডা মাথায় খেললেন রুট। তিনি জানতেন, ব্রুক বড় শট মারার চেষ্টা করবেন। তাতে আউট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে। তাই তাঁকে ধরে খেলতে হবে। দলের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাটার সেই কাজটা ভাল ভাবে করলেন। ব্রুক আক্রমণ করায় রান তোলার গতি কমছিল না। যত সময় গড়াচ্ছিল, ভারতীয় পেসারেরা তত ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। এই পিচে স্পিনারদের জন্য কিছু না থাকায় তিন পেসারের উপরেই ভরসা করতে হচ্ছিল শুভমনকে। তাঁদেরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বল করাতে হচ্ছিল। চতুর্থ পেসারের অভাব বোধ করলেন শুভমন। আর এক পেসার থাকলে কি কিছুটা সুবিধা হত না তাঁর? আরও এক বিকল্প পেতেন ভারত অধিনায়ক। সেটা পেলেন না।

রুট ও ব্রুক আইসিসি-র টেস্ট ক্রমতালিকায় শীর্ষে থাকা দুই ব্যাটার। কেন তাঁরা এক ও দু’নম্বরে তা আরও এক বার দেখালেন দুই ব্যাটার। তাঁদের মধ্যে ১৯৫ রানের জুটি হল। তাতেই খেলা ইংল্যান্ডের হাতে চলে গেল। চা বিরতির আগে নিজের শতরান পূর্ণ করলেন ব্রুক। তার পর আরও হাত খোলা শুরু করলেন তিনি। সেটা করতে গিয়ে ৯৮ বলে ১১১ রান করে আকাশদীপের বলে আউট হলেন ব্রুক। সেই সিরাজই তাঁর ক্যাচ ধরলেন। তবে তত ক্ষণে তিনি ইংল্যান্ডকে জয়ের পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন। ব্রুক যখন নেমেছিলেন তখন দলের রান ছিল ১০৬। যখন ফিরলেন তখন রান ৩০১। তখন জয়ের জন্য বাকি আর ৭৩ রান। হাতে রয়েছে আরও ৫ উইকেট।

রুটও শতরান করেন। ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টে এটা তাঁর ১৩তম শতরান। চলতি সিরিজ়ের তৃতীয়। ভারতের বিরুদ্ধে রান করা জলভাতে পরিণত করেছেন রুট। একটা সময় দেখে মনে হচ্ছিল, চা বিরতির পর খেলা শেষ হতে বেশি ক্ষণ লাগবে না। তখনই খেলায় ফিরল ভারত। প্রসিদ্ধ পর পর জেকব বেথেল ও রুটকে আউট করলেন। ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, চাপে পড়ে গিয়েছে। উল্টোদিকে ছন্দে ছিলেন ভারতীয় পেসারেরা। ঠিক তখনই বৃষ্টি নামল। আর খেলা শুরু করা যায়নি। খেলা গড়ায় পঞ্চম দিনে। সেখানে ৬ রানে জিতল ভারত।

এই ড্রয়ের পর কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন গম্ভীর। ভারতের কোচ হিসাবে চারটে টেস্ট সিরিজ় খেলেছেন তিনি। ঘরের মাঠে বাংলাদেশকে হারিয়ে শুরু করেছিলেন। তার পর শুধুই ব্যর্থতা। গত বছর ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে তিন টেস্টের সিরিজ়ে চুনকাম হয়েছেন। তার পর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ১-৩ সিরিজ় হেরেছেন। সেই সঙ্গে গত টেস্ট বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন পর্বেও শুরুটাও খারাপ হতে পারত। ইংল্যান্ডে হার তাঁর কফিনে শেষে পেরেক পুঁতে দিতে পারত? কিন্তু শুভমনদের লড়াই তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। হারের আগে দলের না হারার মানসিকতা দেখে হয়তো একটু হাসি ফুটবে গম্ভীরের মুখে।

Advertisement
আরও পড়ুন