Harvansh Singh

ক্রিকেটের জন্য কানাডায় যাননি বাবার সঙ্গে, তাঁর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই ভারতীয় দলে হরবংশ

অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ না পেলে কানাডায় বাবার কাছে চলে যেতে হত হরবংশ সিংহকে। পারিবারিক পরিবহণ ব্যবসায় কাজ করতে হত। সেই সম্ভাবনাকে দূরে সরিয়ে ইংল্যান্ডে যাচ্ছেন গুজরাতের তরুণ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৫ ২২:৪১
Picture of Harvansh Singh

হরবংশ সিংহ। ছবি: এক্স (টুইটার)।

ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন হরবংশ সিংহ। চাইলে কানাডার হয়ে ক্রিকেট খেলতে পারতেন গুজরাতের তরুণ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। কিন্তু দেশ ছাড়তে চাননি। যুবরাজ সিংহের ভক্ত ভারতের হয়ে খেলতে যাবেন ইংল্যান্ডে। বাবার দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই হরবংশ পরতে চলেছেন দেশের জার্সি।

Advertisement

গুজরাতের কচ্ছের রানের কাছে ছোট্ট শহর গান্ধীধামের বাসিন্দা হরবংশের ক্রিকেট খেলা শুরু বাবা দমনদীপ সিংহ এবং জেঠা কুনওয়ারজিৎ সিংহকে দেখে। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন উইকেটরক্ষক। জেলা পর্যায়ে খেলেছেন দু’জনেই। পরে তাঁরা চলে যান কানাডায়। সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। হরবংশের বাবা দমনদীপ কানাডায় ট্রাক চালান। ছেলের ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার খবর যখন পান, তখন কানাডায় রাত ৩টে। ছেলের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত দমনদীপ বলেছেন, ‘’১৫-১৬ ঘণ্টা ট্রাক চালানো পর ঘুমোচ্ছিলাম। মোবাইলের ভাইব্রেশনে সহজে ঘুম ভাঙেনি। অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। খুব ভাল লাগছিল। ওকে কানাডায় আমার কাছে চলে আসতে বলেছিলাম। রাজি হয়নি। দেশে থেকে স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছিল। সে দিনের কথা খুব মনে পড়ছে।’’ দমনদীপ আরও বলেছেন, ‘‘ছোটবেলায় আমি আর আমার দাদা ক্রিকেট-পাগল ছিলাম। তবে আমাদের খেলাটা ছিল সখের।’’

নিজেরা ক্রিকেটার হতে পারেননি। তাই হরবংশের ইচ্ছায় বাধা দেননি। ছেলের ক্রিকেট শুরুর দিনের কথা শুনিয়েছেন দমনদীপ। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের বাড়ি থেকে রাজকোট ২০০ কিলোমিটার দূর। কাছাকাছি ক্রিকেট শেখার কোনও জায়গা ছিল না। ২০১২ সালে সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আমাদের শহরে অ্যাকাডেমি তৈরি করে। তখন হরবংশ ছয় বছরের। ওকে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। ক্রিকেটের প্রাথমিক কিছু জিনিস দ্রুত শিখে ফেলেছিল। দেখলাম ওর আগ্রহ আমার মতোই উইকেট রক্ষায়। আমিও খারাপ ছিলাম না। তবে ছেলের ক্রিকেটে যুবরাজ সিংহের অনেকটা প্রভাব আছে।’’ কেমন সেই প্রভাব? দমনদীপ বলেছেন, ‘‘ও যুবরাজের ভক্ত। যুবরাজের খেলা দেখত। ওর মতো খেলার চেষ্টা করত। যুবরাজের ব্যাটিংয়ের ভিডিয়ো দেখত। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্টুয়ার্ট ব্রডকে এক ওভারে ছ’টা ছক্কা মারার ভিডিয়ো।’’

২০১৭ সালে কানাডায় চলে যান দমনদীপ। সেখানে আগে থেকেই থাকেন তাঁর দাদা এবং দিদি। ছেলেকেও নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তত দিনে ক্রিকেটকে ভালবেসে ফেলা হরবংশ রাজি হননি। দমনদীপ বলেছেন, ‘‘আমার মা, দাদা, দিদি সকলে আগেই পাকাপাকি ভাবে কানাডায় চলে গিয়েছিল। আমারও একই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হরবংশ দেশ ছাড়তে রাজি হয়নি। আমি এবং আমার স্ত্রী জসপ্রীত কৌর ওকে অনেক বোঝাই। কিন্তু হরবংশকে কোনও ভাবেই রাজি করাতে পারিনি আমরা। ও একটাই কথা বলত, ভারতের হয়ে খেলতে চাই।’’ কী বলেছিল ছেলে আপনাকে? দমনদীপ বলেছেন, ‘‘ও শুধু বলব, ‘বাবা আমি ভারতের হয়ে খেলতে চাই।’’ আমরা তো বটেই, আমাদের অনেক আত্মীয়ও ওকে বুঝিয়েছিল। কানাডায় এলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা আরও সহজ হতে পারে। কারণ এখানে প্রতিযোগিতা অনেক কম। কিন্তু কোনও কথাই শোনেনি। বলেছিল, ‘বাবা জীবনে সহজে কিছু পেতে চাই না আমি। আর খেললে আমি ভারতের হয়েই খেলব। অন্য কোনও দেশের হয়ে নয়।’ তার পর আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।’’

সে সময় হাল ছেড়ে দিলেও ছেলেকে একটি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন দমনদীপ। কী সেই সিদ্ধান্ত? দমনদীপ বলেছেন, ‘‘হরবংশকে বলেছিলাম, ঠিক আছে তুমি ভারতে থাক। ক্রিকেট খেল। কিন্তু ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ না পেলে আর কোনও কথা শুনব না। ব্যাগ গুছিয়ে সোজা কানাডায় চলে আসবে।’’ দমনদীপ রুজির খোঁজে কানাডা গেলেও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। ছেলের জন্য দেশেই রেখে যেতে হয় জসপ্রীতকে। হাসতে হাসতে দমনদীপ বলেছেন, ‘‘কানাডায় এখন আমি আমার মায়ের সঙ্গে থাকি। আর ভারতে হরবংশ ওর মায়ের সঙ্গে।’’

পরিবার ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে না দমনদীপের। তবু ছেলের স্বপ্নের জন্য কষ্ট মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘কানাডায় আমাদের পরিবহণের ব্যবসা। প্রথমে অফিসে বসতাম। এখন আমাকেও ট্রাক চালাতে হয়। সপ্তাহে ছ’দিন রাস্তাতেই কেটে যায়। দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয়। খুব ক্লান্ত থাকি সপ্তাহের শেষে। এখানে জীবন খুব পরিশ্রমের। খুব কষ্টের। তবে ছেলের ক্রমাগত উন্নতি সেই কষ্ট অনেকটাই কমিয়ে দেয়। মনে হয় কষ্টের দাম ঠিক পাওয়া যায়। ছেলে এখন বড় হয়েছে। আমাকে মাঝে মাঝেই বলে দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু আমাকে এখনও খাটতে হবে। ছেলের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমাতে হবে। যদি ক্রিকেটটা মাঝ পথে থমকে যায়। পরে যদি তেমন কিছু করতে না পারে। সে জন্যই রোজগার করে চলেছি।’’

বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার আগে বাবাকে ফোন করেছিলেন হরবংশ। ১৩,২৯৬ কিলোমিটার দূরে দমনদীপ তখন তৈরি হচ্ছিলেন আরও একটা ১৪ ঘণ্টার যাত্রার জন্য। বাবা-ছেলে দু’জনেই এগিয়ে চলেছেন নিজেদের লক্ষ্যে। পৃথিবীর দুই প্রান্তে।

Advertisement
আরও পড়ুন