রোগীর কাছে বিক্রি করা শ্রবণযন্ত্রে সরকারী ছাপ মারা। নিজস্ব চিত্র।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এখনও পর্যন্ত নিখরচায় বা পিপিপি মডেলে শ্রবণযন্ত্র দেওয়া চালু করেনি। অথচ, মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্তের দাবি, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কানের পরীক্ষার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি সংস্থা সরকারি হাসপাতাল থেকে রেফার করা রোগীদের যে শ্রবণযন্ত্র বিক্রি করছে তার অধিকাংশতেই সরকারি ‘সিল’ রয়েছে। পাশাপাশি ওয়ারান্টি কার্ডে ‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এভি ক্লিনিক’ বলে স্ট্যাম্প দেওয়া রয়েছে! এ রকম অনেক কার্ড আদালতে জমা দিয়েছি। ক্রেতার তালিকায় অনিরুদ্ধ ধর, আব্দুল্লা শেখ, নিরাপদ হালদারের মতো অজস্র রোগী রয়েছেন।’’ এই স্ট্যাম্প ‘রহস্য’ জানতে মেডিক্যালের সুপার অঞ্জন অধিকারীকে ফোন ও মেসেজ করলেও উত্তর মেলেনি।
সরকারি ছাপ মারা শ্রবণযন্ত্রগুলির উৎপাদক সংস্থা নবি মুম্বইয়ের। কলকাতা হাইকোর্টে অভিযোগকারী সংস্থা গত মে মাসের ৩ তারিখ ওই সংস্থাকে চিঠি লিখেও এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যে সংস্থার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ, সেই ‘বরানগর স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং ক্লিনিক’-এর অধিকর্তা অনন্ত বিকাশ বসু প্রথমে বলেন, ‘‘ষড়যন্ত্র হয়েছে আমাদের সঙ্গে। সরকার আমাদের কোনও ত্রুটি খুঁজে পায়নি।’’ তারপর তাঁর মন্তব্য, ‘‘তবে এর বেশি কিছু বলব না। বিচারাধীন বিষয়। যা বলার আদালতকে বলব।’’
সরকারি হাসপাতালে কানের চিকিৎসায় দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে যে নথি হাই কোর্টে জমা পড়েছে তার বড় অংশ হল, যাঁদের শ্রবণযন্ত্র প্রয়োজন নেই, ‘বানানো’ রিপোর্ট দিয়ে তাঁদের শ্রবণযন্ত্র কিনতে বাধ্য করা সংক্রান্ত।
মালদহের বাসিন্দা বছর ৩০-এর নিপ্রা দাসের চিঠির কথাই ধরা যাক। চলতি বছর ১২ মে এবং ১৭ মে পর পর দু’টি অভিযোগপত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন’কে জমা দিয়েছেন নিপ্রার স্বামী পেশায় দিনমজুর ডালিম দাস। সেখানে তিনি লেখেন, মাথা ঘোরার সমস্যার জন্য নিপ্রাকে ২০২৩ সালে মেডিক্যালে ইএনটি-র পিপিপি কেন্দ্রে দেখানো হয়। সেখানে তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ডিজিটাল শ্রবণযন্ত্র কিনতে বলা হয়। ধার করে ৬২ হাজার টাকা জোগাড় করে তাঁরা শ্রবণযন্ত্র কেনেন। কিন্তু তা বসানোর পরেও সমস্যা মেটেনি। তখন তাঁরা এসএসকেএমে যান। এসএসকেএমের রিপোর্ট বলছে, নিপ্রার কানের স্নায়ুর সমস্যাই নেই! সমস্যাটা হাড়ের! ফলে শ্রবণযন্ত্রের প্রয়োজনই ছিল না! গত ৯ এপ্রিল এসএসকেএমে নিপ্রার কানের অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর সমস্যা মিটে যায়। এর পরে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়ে ডালিম জানতে চান, বিনা কারণে তাঁকে দিয়ে যে শ্রবণযন্ত্র কেনানো হল, সেটা নিয়ে এখন তিনি কী করবেন? সেটি ফেরত নেওয়া হোক। ১২ এপ্রিল ডালিমের কাছে একটি ফোন আসে। ডালিমের কথায়, ‘‘এক জন ফোনে জানান, এসএসকেএম থেকে বলছেন। আমার বাড়ি এসে কানের যন্ত্র ফেরত নিয়ে যাবেন। পরের দিন এক জন এলেন। তিনি কোনও রসিদ ছাড়াই আমার হাতে ৫০ হাজার টাকা গুঁজে দিলেন। তারপর কানের যন্ত্রের সঙ্গে মেডিক্যাল ও এসএসকেএমের চিকিৎসার সব কাগজপত্র নিয়ে চলে গেলেন!’’
অভিযোগে উঠে এসেছে সরকারি হাসপাতালে পিপিপি মডেলে চলা কান পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে ‘অডিয়ো-স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথোলজিস্ট’ পদে নিয়োগ দুর্নীতির কথাও। যেমন, কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে এক স্পেশাল এডুকেটর বেআইনি ভাবে এই পদে থেকে পরীক্ষা ও রিপোর্টে সই করছিলেন বলে অভিযোগ। নীলরতনে কর্মরত অডিয়ো প্যাথোলজিস্টের তিনটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল। তার মধ্যে দু’টি ভুয়ো। তৃতীয়টি কার্যকর হয়েছিল ২৫ মার্চ ২০২৫ থেকে। কিন্তু তিনি তার অনেক আগে থেকেই কাজ করছিলেন ও সরকারি হাসপাতালে রিপোর্ট সই করছিলেন বলে অভিযোগ। নীলরতনের অন্য এক অডিয়োলজিস্ট ভুয়ো রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁর মাত্র ১১ মাসের ইন্টার্নশিপ রয়েছে মধ্যপ্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নীলরতনেই আরও এক অডিয়োলজিস্ট ইউনিটে যোগ দিয়েছিলেন ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার আগেই। নিয়োগের অভিযোগে নীলরতন তদন্ত কমিটি গড়ে। তারা রিপোর্ট দেয় ২০২৫ এর ২৩ জুন। তাতে তদন্তকারীরা মেনে নেন, নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ সত্যি। সেই রিপোর্টও আদালতে দেওয়া হয়েছে।
কোর্টে কাগজ জমা পড়েছে নিয়ম না মেনে একাধিক মেডিক্যাল কলেজে বেরা অস্ত্রোপচার, ককলিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং টাকা নিয়ে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শংসাপত্র দেওয়া নিয়েও। মামলাকারী সংগঠনের সচিব অরূপ নন্দন দাস অধিকারীর অভিযোগ, ‘‘সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পিপিপি মডেলে চলা কান পরীক্ষা কেন্দ্রগুলি দুর্নীতিতে ডুবে। যথাযথ তদন্ত হলে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে।’’ (শেষ)