জেমস লং সরণিতে চায়ের দোকানে ছেলে শুভর ছবি নিয়ে মা ছবি প্রামাণিক। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
বেতন সময় মতো হত না। উপরন্তু বাড়তি কাজ করিয়ে নেওয়া হত। অসুস্থতা বা জরুরি কারণে কাজে যেতে না পারলে কাটা যেত বেতন। ছাড়ব ছাড়ব করেও হরিদেবপুরের মতিলাল গুপ্ত রোডেরপ্লাস্টিকের বোতল তৈরির কারখানার কাজটা ছেড়ে ওঠা হচ্ছিল না হরিদেবপুর পূর্ব বড়িশার শুভ প্রামাণিকের। বাড়িতে তিন মাসের বিয়ে করা বৌ। তার উপরে সামনে পুজো। বিয়ের পরের প্রথম পুজো, কেনাকাটা, লোক-লৌকিকতা— টাকার দরকার যে!
কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসে শুভর মা ছবি প্রামাণিকের। এখন তাঁর সংসার চালাতে ভরসা ছোট্ট চায়ের দোকানটা। সেখানে দাঁড়িয়েই কোনও মতে তিনি বলেন, ‘‘টানাটানির সংসার চালাতে দাঁতে দাঁত চেপে কাজটা করে যাচ্ছিলছেলে। তবে বলেছিল, পুজোর বোনাস আর বেতনটা পেয়ে গেলে কাজটা ছেড়ে দেবে। অন্য ভাল কোনও কাজ খুঁজবে। কিন্তু, তা আর হল কই!’’ গত পুজোর আগে, দ্বিতীয়ার দিন রাতভর বৃষ্টির জমা জল পেরিয়েও কাজে গিয়েছিলেন শুভ। বুঝতে পারেননি, জমা জলে অপেক্ষা করছে মৃত্যু! বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সে দিন লুটিয়ে পড়েন বছর চব্বিশের ওই যুবক। সেখানেই সব শেষ।
শুভ একা নন। ফেলে আসা বছর ঘুরে দেখলে শুভর মতোই উঠে আসে এমন একাধিক নাম। এক রাতের বৃষ্টিতে শহরের রাস্তা যাঁদের জন্য মৃত্যু-ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গত ২৩ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয়ার ওই রাত এবং পরের দিন মিলিয়ে কলকাতায় ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সকলেই জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন বলে পুলিশি রিপোর্টে উঠে আসে। পুরো নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন ওঠে। মেয়র থেকে পুরকর্তাদের একাংশ দাবি করেন, ‘‘এত বেশি মাত্রায় বৃষ্টি হলে কার কী করার আছে?’’ প্রশ্ন ওঠে,কেন দ্রুত শহরের জমা জল সরবে না? কেন উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা থাকবে না? আরও বড় প্রশ্ন, জমা জলের মধ্যে কেন পড়ে থাকবে বিদ্যুতের তার? ভুক্তভোগী থেকে সচেতননাগরিকদের বড় অংশ এখন বলছেন, ‘‘নতুন বছর শুরুর আগে বড় প্রশ্ন, পুরনো বছরের এই সব ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া হল কি? নতুন বছরেও বৃষ্টি এলে আবার এমন বেঘোরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে না তো?’’ প্রশাসনিক মহলের যদিও দাবি, ওই ঘটনার পরে মৃতদের পরিবারপিছু রাজ্য সরকারের তরফে দু’লক্ষ টাকা এবং বিদ্যুৎ সংস্থা সিইএসসি-র তরফে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা আটকাতে পুর-প্রশাসনের সমস্ত স্তরকে সতর্ক করা হয়েছে।
ওই দিনই জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া, একবালপুরের বছর ৬০-এর জিতেন্দ্র সিংহের পুত্র প্রিয়াংশু যদিও বললেন, ‘‘টাকা আর চাকরি তো জীবনের সমতুল নয়। তা ছাড়া, কোনও মৃত্যুতেই কিছু বদলায় না। ওই দিনের পরেও তো শহরে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর একাধিক ঘটনা ঘটেছে!’’ জিতেন্দ্র ছিলেন পেশায় গাড়িচালক এবং পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। বড় ছেলে প্রিয়াংশু এ জে সি বসু কলেজে পড়াশোনা করতেন। একবালপুরের ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে তাঁদের বাড়ি।
স্থানীয়দের দাবি, বৃষ্টি হলেই ওই তল্লাটে হাঁটুজল জমে। সেই জমা জলের মধ্যে ভোরে শৌচাগারে যাওয়ার জন্য জিতেন্দ্র বেরিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। একই ভাবে, জমা জলে বেরিয়ে আর ফেরেননি বালিগঞ্জ প্লেসের সন্দীপ গুহঠাকুরতা। তিনি যে বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতেন, তার সামনেই জলে ভাসতে দেখা গিয়েছিল তাঁর দেহ।
জমা জলে বেরিয়ে একই পরিণতি হয়েছিল পেশায় গাড়িচালক, গরফার রামগোপাল পণ্ডিতের। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, গাড়ি চালানোর কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন বছর তিপ্পান্নের রামগোপাল। কালিকাপুর মোড়ের কাছে জমা জলের মধ্যে, সাইকেলের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় তাঁর মৃতদেহ।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর শহরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একাধিক মৃত্যুর পরে এ ভাবেই জমা জলে ভাসতে দেখা গিয়েছিল কারও কারও দেহ। —ফাইল চিত্র।
নেতাজিনগর বাস স্ট্যান্ডের কাছে একই ভাবে জলের মধ্যে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল প্রাণতোষকুণ্ডুর নিথর দেহ। ফলের দোকান চালানো প্রাণতোষ বৃষ্টির পরে বেরিয়েছিলেন দোকান ঠিক আছে কিনা দেখতে। সাইকেল এক পাশে রেখে জলে পা দিতেই সব শেষ!
বাড়ির বারান্দায় রাখা নীল রঙের সেই সাইকেল দেখিয়ে প্রাণতোষের ছেলে দোলন কুণ্ডু বললেন, ‘‘এইসাইকেলটাই বাবার বারো মাসের ভরসা ছিল। রোজ সকালে সাইকেল নিয়ে দোকানে যেতেন। উৎসবের দিনগুলিতে বিভিন্ন খাবার নিয়ে ফিরতেন। বড়দিন, নববর্ষের সময়ে আমার মেয়ের জন্য কেক আনতেন। মানুষটা যে নেই, বিশ্বাস হয় না। এখনও সাইকেলের আওয়াজ শুনলেই মনে হয়, ওই তো বাবা আসছেন।’’
একই রকমঅপেক্ষায় শুভর স্ত্রী। বিয়ের তিন মাসের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে এখন মা-বাবার কাছে ফিরে গিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘নতুন বছরের কথা ভেবে আর কী হবে? এক-একটা দিন যে যাচ্ছে, সেই নিয়েই তো আর কোনও উৎসাহ নেই। ভালবাসার মানুষটাই তো আর নেই!’’