ভাঙচুর চালানের পর ছায়ানটের অন্দরের পরিস্থিতি। ছবি: রয়টার্স।
‘১৮ তারিখ (বৃহস্পতিবার) রাত ১২টার পর ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুকে উপলক্ষ করে’ হামলা চালানো হয়েছে ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে। শুক্রবার এই অভিযোগ তুললেন ‘ছায়ানট’ কর্তৃপক্ষ। ভাঙচুর ও লুঠতরাজের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগের চেষ্টা হয়েছে বলেও জানালেন তাঁরা। ছ’তলা ভবনের সব সিসি ক্যামেরা-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর এবং ফোন ও ল্যাপটপ লুটের অভিযোগ তোলা হয়েছে সভাপতি সারওয়ার আলি এবং সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার যৌথ বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, ‘‘ছায়ানট একটি স্বেচ্ছাসেবী এবং স্বনির্ভর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ছায়ানট কোনও সরকার, বিদেশি সংস্থা বা কর্পোরেট অনুদান গ্রহণ করে না। সুতরাং, ছায়ানট আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই ক্ষতিপূরণ করবে।’’ সারওয়ার এবং লাইসার অঙ্গীকার, তাঁরা সংগীত এবং শিশুদের সাধারণ শিক্ষায় এই সাময়িক বিঘ্নের দ্রুত প্রতিকার করতে বদ্ধপরিকর। ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে ছায়ানটও গভীরভাবে শোকাহত জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘কিন্তু ওই সূত্র ধরে ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে কেন হামলা সংঘটিত হল, তা মোটেই বোধগম্য নয়।’’ হাদির মৃত্যুর পর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংস্কৃতি চর্চার বিরোধী শক্তি এই হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন ছায়ানট কর্তৃপক্ষ।
গুলিবিদ্ধ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি বৃহস্পতিবার মারা যাওয়ার পর ঢাকায় তুমুল অশান্তির আবহে ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনে হামলা হয়। পাকিস্তান জমানায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের দফতরে হামলা হয় মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার। অভিযোগ, কট্টর ইসলামপন্থী স্লোগান দিতে দিতে সংগঠিত ভাবে মিছিল করে গিয়ে সেখানে হামলা চালানো হয়। চলে তাণ্ডব ও লুটপাট। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি-বই। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রও। বিক্ষোভকারীরা ছিঁড়ে দেয় ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সঞ্জীদা খাতুনের ছবিও। রেহাই পায়নি লালন এমনকি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ছবিও! হামলাকারীরা ভবনের প্রতিটি তলা তছনছ করে। বিভিন্ন সামগ্রী নীচে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই দিন কট্টরপন্থীদের আক্রমণের শিকার হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার।
ছায়ানটের প্রতিক্রিয়া।
ছায়ানটের নববর্ষ উৎসব ইউনেস্কো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কিন্তু গত বছরের ৫ অগস্টের পালাবদলের পর থেকেই কয়েকটি কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপনের বিরোধিতা করেছে প্রকাশ্যে। শুক্রবার বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ছায়ানট ভবনে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। শুক্রবার বেলা আড়াইটে নাগাদ ধানমন্ডির শঙ্করে ছায়ানট ভবন পরিদর্শন করেন তিনি। সেই সঙ্গে, ছায়ানটের সংগঠক পার্থ তানভীর নভেদ-সহ কয়েক জন আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনাও করেন। ছায়ানট কর্তৃপক্ষের তরফে দোষীদের চিহ্নিত করার আবেদন জানানো হয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার কাছে।
পরিদর্শন শেষে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, “সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। এই ভবনে হামলা চালানো হয়েছে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমি ছায়ানট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে প্রতিষ্ঠানটি যেন দ্রুত চালু করা যায়, এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা-সহ সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে। ছায়ানট পরিচালনা কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ বিষয়ে আমাদের জানাবেন বলে জানিয়েছেন।” ফারুকীর কথায়, “এই ভবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছি। ছায়ানটের বাইরে বিজিবি ও পুলিশ কঠোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। আমি উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্যদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।” হামলার নেপথ্যে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা অবশ্যই নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র। আজ আমাদের কথা বলার কথা শহিদ ওসমান হাদিকে নিয়ে। আজ আমাদের শোকাতুর হওয়ার কথা। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়েছে কারা? কারা প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটে হামলা করেছে? যারা করেছে, তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ চায় না।”
ইউনূস সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, “এই জাতীয় শোকের মুহূর্তে এক শ্রেণির হঠকারীরা দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’-এ হামলা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করেছে। মৃত্যুঞ্জয়ী হাদির মৃত্যুতে কোনও সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলা কেবল একটি ফৌজদারি অপরাধই নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থী।” অন্যদিকে, সারওয়ার এবং লাইসা বাঙালির আবহমান সংগীত–সংস্কৃতির সাধনা ও প্রসারে ছায়ানট তার মতো করেই কাজ করে যাবে জানিয়ে লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘ছায়ানটের কাজের ক্ষেত্র রাজনীতি নয়, সংগীত–সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে ছায়ানট। ছায়ানট সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সমাজ গড়তে প্রয়াসী।’’