ঢাকায় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন। —নিজস্ব চিত্র।
সেই কবে এই জনপদের কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার গ্রামের আখড়ায় ফকির লালন সাঁইজি উচ্চরণ করেছিলেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। সেই উচ্চারণকে ধারণ করেই সত্যিকারের মানুষ হওয়ার বিষয়ে এ বারের শপথ ছিল ঢাকায়, বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। মানুষের ভিড়ে এ বারের শোভাযাত্রার মিছিল হয়ে উঠেছিল মহামিছিল। সেই পুরনো পোশাকের ঢাকিরা সার বেধে বোল তুলেছেন ঢাকে। তালে তালে নাচছে শিশু থেকে বৃদ্ধ। জানান দিচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সব মানুষের উৎসব পয়লা বৈশাখের অমিত শক্তির কথা।
অন্ধকার অপশক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে সবচেয়ে শক্তিমান বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। সেই ধারণাকে ধারণ করেই আয়োজিত হয়ে চলেছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার। প্রায় প্রত্যেকের হাতে বিশাল আকারের মুখোশ, শোলার সেই প্রাচীন রূপকথার পাখি, টেপা পুতুল, বিভিন্ন মঙ্গল প্রতীক। ‘‘এই শোভাযাত্রায় একটাই শপথ— মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার যে আকাঙ্ক্ষা, প্রতিপাদ্যে সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চায় মঙ্গল শোভাযাত্রা,’’— এমনটাই বললেন শোভাযাত্রা আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানবিক একটি সমাজের ভাবনা থেকেই সাজানো হয়েছে এ বারের শিল্পকাঠামোগুলো।’’ আটটি প্রতীকে সাজানো হয়েছিল শোভাযাত্রা। সূর্য, বক-মাছ, হাতি, পাখি, সাইকেলে মা-শিশু, টেপা পুতুল, মহিষ— চার রকম পাখি এবং জেলে। এ বারের শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান। বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও অংশ নেন শোভাযাত্রায়।
গত কয়েক বছরের টানা জঙ্গি আর ধর্মান্ধদের হুমকির কারণে এ বারেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে থেকে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী। শোভাযাত্রার উপর দিয়ে টহল দিয়েছে র্যাবের হেলিকপ্টার।
আরও পড়ুন: শুঁটকি ভর্তা দিয়ে পান্তা, ইলিশে না হাসিনার
শোভাযাত্রায় বর্ষবরণ ঢাকায়।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে সেই সময়ের ক্ষমতার দখলদার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের বার্তা নিয়ে শুরু হয়েছিল পয়লা বৈশাখের দিনের প্রথম ভাগের এই আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬-তে আনন্দ শোভাযাত্রার নাম বদলে রাকা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বছর বছর বাড়তে থাকে সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। এখন সেই শোভাযাত্রা রূপ নিয়েছে ঢাকা শহরের প্রধান বর্ষবরণের আয়োজনের। শুধু ঢাকা শহরেই নয়— জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও এখন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আয়োজন করছে এই শোভাযাত্রার। শেষ পর্যন্ত বাঙালির বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: সব কোটা তুলে দেওয়ায় খুশি ঢাকা, ধন্দেও
রংবেরঙের শোভাযাত্রা নিয়ে মানুষের ঢল।
দেশ জুড়ে যেমন ছড়িয়ে পড়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন, তেমনই এই শোভাযাত্রার বিরোধিতাও ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে মাথাচাড়া দেওয়া জঙ্গিবাদ, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠন হুমকি ও বিরোধিতা করেই চলেছে বাংলা বর্ষবরণের এই আয়োজনের। তবে সেই হুমকি বা বিরোধিতায় মোটেই থমকে যায়নি এই আয়োজন। উল্টে প্রতি বছরেই বাড়ছে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উপস্থিতির সংখ্যা, বাড়ছে আরও বেশি বাঙালিআনায় বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে সকল অপশক্তিকে না বলে জানান দেওয়া মানুষের সংখ্যা।
‘‘এই উপস্থিতিই আশাবাদ,’’— এমনই বললেন বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুস। তিনি বললেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ কখনওই কোনও অপশক্তির কাছে মাথা নোয়ায়নি। আর ভয়কে জয় করে চলার যে পথ, সেটিই বাঙালির পথ। এ বারের শোভাযাত্রায় যে মানুষের ঢল, সেটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশ পথ হারায়নি, অন্ধকার কখনও শেষ কথা নয়।’’ সেটাই জানান দিল আজকের মানুষের মিলিত ঢল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy