Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Bangladesh News

চান্দলা জানে, ভিটে জ্বললেও সম্প্রীতি পোড়ে না

আমার জন্ম পূর্ব বাংলার একেবারে পূবে, ভারতের সীমান্তঘেঁষা একটি অজ পাড়াগাঁয়ে। গ্রামের নাম চান্দলা, গঙ্গামণ্ডল পরগনা, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা; সময়টা ১৯৬১। আমি নিপাট সমতটী।

মুক্তিযুদ্ধে সামিল যোদ্ধারা।

মুক্তিযুদ্ধে সামিল যোদ্ধারা।

সোমনাথ দাস চান্দল্য
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:০০
Share: Save:

আমার জন্ম পূর্ব বাংলার একেবারে পূবে, ভারতের সীমান্তঘেঁষা একটি অজ পাড়াগাঁয়ে। গ্রামের নাম চান্দলা, গঙ্গামণ্ডল পরগনা, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা; সময়টা ১৯৬১। আমি নিপাট সমতটী। নিকটবর্তী বাসস্টপ বা রেলস্টেশন যথাক্রমে সাত ও দশ কিলোমিটার দূরে। বর্ষাকালে একমাত্র বাহন নৌকা, বাড়িগুলি এক একটি দ্বীপ। অন্য সময় পদব্রজেই যাতায়াত করতে হয়। গ্রামটি লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার, প্রস্থে গড়ে দেড় কিলোমিটার হবে। ছয় ঋতুর স্পষ্ট আবর্তনে প্রকৃতিও সাজিয়ে দিয়েছে বাংলা মায়ের নকশি আঁচল। পলিসমৃদ্ধ কৃষিজমি উর্বর, বছর বছর। সম্পদের প্রাচুর্য অফুরান না হলেও অভাব তেমন কিছুই নেই। সন্তানেরা আছে দুধে ভাতে, সম্প্রীতি সুখে। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আবাস। মা-ঠাকুমার জাগরণী গানে প্রভাতী আজানে প্রতি দিন ভোরে সাতঘোড়া রথে সূর্য নামে পূবের মাঠে। যেন এক রাতের অদেখা বঙ্গভূমির সম্প্রীতির সুখ সুষমা অবলোকন করতে বালার্কের এই আকুল প্রকাশমাধুরী। অজ পাড়াগাঁ হলেও বর্ধিষ্ণু এই গ্রামের মানুষেরা ১৯১১ সালে ইংলিশ মাইনর স্কুল স্থাপনা করেন আর ক্রমে একসময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইস্কুলের স্বীকৃতি আদায় করে নেন।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষটা আর সত্তরের দশকের শুরু, সময়টা অগ্নিক্ষরা। উনসত্তরের গণজাগরণ, আয়ুবশাহির পতন, শেখ মুজিব-সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সকল অভিযুক্তের মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জনমতের প্রবল চাপে ইয়াহিয়ার সাধারণ নিবার্চনের ঘোষণা, আওয়ামি লিগের নিরঙ্কুশ বিজয়। সব মিলিয়ে উত্তাল বাঙালি। এক বুক আশায় বুক বাঁধে, শাসন ক্ষমতা এ বার বাঙালির হাতে আসবে! জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি যায়, মার্চ আসে, খলের ছলের অভাব নাই! চলে টালবাহানা চক্রান্ত, চক্রী ভুট্টু ইয়াহিয়া...। গণতান্ত্রিক প্রথায় ক্ষমতা হস্তান্তরের নাম গন্ধ নাই। অস্থির উত্তাল হয়ে উঠে বাঙালি। বুঝে যায়, এত সহজে মসনদ ছাড়বে না নাপাক পশ্চিমা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দান থেকে বজ্রকণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান আসে, ‘‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক...। এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...।’’ পশ্চিমারাও ভয়ানক গোপন পরিকল্পনায় মাতে। ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নাপাক হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা লুন্ঠন ধর্ষণ অগ্নি সংযোগ-সহ নারকীয় উল্লাসে মাতে। সে দিনই বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আমাদের গ্রামেও শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।

কাতারে কাতারে মানুষ শহর ছেড়ে সীমান্ত নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ভারত সীমান্ত খুলে দেয়। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায়শ তখন দূরে কসবা অঞ্চলের দিক থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। হানাদারেরা জামাত-ই ইসলাম ও মুসলিম লিগের সদস্যদের (পরে রাজাকার আলবদর আলশামস নামধারী) সঙ্গে নিয়ে শহরে গ্রামে বেছে বেছে হিন্দু আর আওয়ামি লিগারদের বাড়ি আক্রমণ করে। হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ চলতেই থাকে অবিরাম।

আমাদের বাড়ির সিদ্ধান্তমতো ছোটদের আর যুবক-যুবতীদের পয়লা বৈশাখের আগেই ত্রিপুরায় নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। আমার তখন ন’বছর। ‘সনের পইলা’ (নববর্ষ) এই প্রথম বাড়ির বাইরে। মন খারাপ লাগে। তবু কী করা যাবে? এ যে সংগ্রামের বছর। এ যে বাঙালির শোষণ মুক্তির সংগ্রাম মরণপণ। সময় বোধহয় তার বিশেষ আবহে শিশু কিশোরকেও প্রস্তুত করে দেয় বয়সের সীমানা ছড়িয়ে।

আশ্রয়ের খোঁজে।

চান্দলা গ্রামে হিন্দু বসতি বেশি, আওয়ামি লিগ নেতারও অভাব নাই, আবার সীমান্তের নিকটবর্তী। পাক সেনাদের জন্য আদর্শ টার্গেট এই গ্রামটি।

এপ্রিলের শেষের দিকে পাক হানাদার বাহিনী ভিন্ন গ্রামের জামাতি ইসলামি ও মুসলিম লিগ সদস্যদের (পরে রাজাকার) দলবল সমেত চান্দলা গ্রামে হানা দেয়। গ্রামের হিন্দুরা তখন গ্রামেই, প্রতি ঘরেই মানুষ আছে। তবে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। উত্তর চান্দলা দিয়ে ওরা গ্রামে ঢোকে। সেখানে পানের বরজ অনেক, সকলেই হিন্দু। ওরা সেখানে তাণ্ডব চালায়, হিন্দু বাড়িগুলোতে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ চলে যথেচ্ছ। উত্তর চান্দলায় হতভাগ্য কেতু পাল আর মনমোহন করকে ধরে ফেলে। দক্ষিণ চান্দলায় উমেশ বণিক আর আওয়ামি লিগের ফরিদ আহমেদ ও আলি আজমকে ধরে ফেলে। ফরিদ আহমেদ আর আলি আজম নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হন, কেননা আমাদের গ্রামের কেউ রাজাকারের দলে ছিল ন। তাঁরা দু’জন প্রাণে বেঁচে যান। বাকি তিন জনকে অকথ্য অত্যাচার করে বেয়নেটে খুঁচিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

আমাদের বাড়িটি গ্রামের একেবারে দক্ষিণে, তাই উত্তর চান্দলায় হানাদার আসার সঙ্গে সঙ্গেই খবর চলে আসে। অনেকটা সময়ও পাওয়া যায় গুছিয়ে নেওয়ার। আমাদের চারিপাড়ায় ষোল ঘর হিন্দু আর প্রায় তিনশো ঘর মুসলমান। খবর হতেই পাড়ার প্রায় সবাই চলে আসে আমাদের বাড়িতে। দ্রুত সিদ্ধান্ত হয়, স্থানান্তরযোগ্য আসবাবপত্র, ধান চাল ডাল, তৈজসপত্র... সব পাড়ার মুসলমান ঘনিষ্ঠজনেরা নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে, পরে আবার ফেরত দিয়ে যাবে। তখনই বাড়ির মহিলাদের নিয়ে চলে যান পাড়ার মুসলমান প্রতিবেশীগণ, নিরাপদ দূরত্বে পাড়ার শেষ প্রান্তে দক্ষিণ দিকে। তারপর শুধু ফসলের মাঠ। সে সময় পাটগাছগুলো যথেষ্ট বড়, প্রিয়জনদের লুকিয়ে রাখার মতো বলিষ্ঠও। কিছু মানুষ সেখানেই পাহারায় থাকে। এ দিকে বাড়ির পুরুষেরা নিজেদের জিনিসপত্র বিলিয়ে যাচ্ছে অকাতরে। পরিকল্পিত সাজানো লুঠের নাটক যেন। এমন লুঠেরা যে আবার ফেরত দেবে সব। এ দিকে কিছু মানুষ বাড়ির উত্তরে পাহারায়। উত্তর দিক থেকেই তো ওরা আসবে। এদের আভাসমাত্র পেলেই খবর পৌঁছে যাবে, হিন্দু পুরুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবে ওরা যেখানে তাদের পরিবারের মহিলাগণ আছেন সেখানে। কৃষিনির্ভর গৃহস্থের ঘরে জিনিসের কি কম আছে? বিলিয়ে শেষ হয় না। সবই দরকারি মনে হয়।

এক সময়ে হানাদার পৌঁছে যায় বাড়ির কাছে। দৌড়ে আসে প্রহরায় থাকা প্রতিবেশী মুসলমান। ‘‘ও দাদা কাহা জেডা— করেন কী, আইয়া পড়ছে পাঞ্জাবি আবু ব্যাপারীর বাড়ি ছাড়াইয়া। ‘‘এক এক জন এক এক জনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ফসলের মাঠ ধরে নিরাপদ আশ্রয়ে। সকলকে নিয়ে পাটখেতের মাঝে লুকিয়ে রাখে, সঙ্গে থাকে কেহ কেহ। কেউ বা পাঞ্জাবির গতিবিধি দেখে দূর থেকে। বুক দিয়ে রক্ষা করতে চায় ভাই ভাইয়ের প্রাণ।

পাক সেনারা আসে, বাড়ির চার দিকে পজিশন নেয়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাকে করে রাখে। কিছু সেনা আর রাজাকারের দল লুণ্ঠন চালায়, গ্রামের লোকেদের বাধ্য করে লুণ্ঠনে যোগ দিতে। লুণ্ঠন শেষে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায় ঘরগুলোতে। আমাদের বাড়ির সব ঘর পোড়ে না। ওরা বেরিয়ে যেতেই পাড়ার লোকেরা আগুন নিভিয়ে দেয়।

ওরা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে, বাড়ির লোকেদের পাড়ার মুসলমানেরা বাড়িতে নিয়ে আসে।

গ্রামের সবাই একত্রিত হয় আমাদের বাড়িতে। আমার বাবা-কাকা-ঠাকুরদারা সমবেত প্রতিবেশীদের কাছে জানতে চান, রায় চান, এখন তাঁরা কী করবেন? তাঁরা বলেন, ‘‘যুগ যুগ ধরে আমাদের একত্র বাস, সুখে-দুখে আমরা সর্বদা একে অন্যের পাশে ছিলাম, আজও আছি। কিন্তু সশস্ত্র এই হানাদারের কবল থেকে আমরা আপনাদের রক্ষা করি কী করে? কখন কী ভাবে আক্রমণ করবে আমরা জানি না। আপনারা চলে যান ভারতে। এটাই যুক্তিযুক্ত ও ঠিক সিদ্ধান্ত হবে। বাড়িঘর গবাদি পশু মাঠের ফসল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যথাসাধ্য করব সব রক্ষা করতে। যে যা জিনিস নিয়ে গেছে সব ফেরত পাবেন ফিরে এলে। দেশ স্বাধীন হবে, আবার আমরা মিলিত হব। ইনশাল্লাহ।’’

আমাদের বাড়িতে তখন শুধু বয়স্কজনেরাই ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন আবার হাঁটতে পারেন না। তাঁদের বাঁকে করে বয়ে নিয়ে আসে সীমান্ত পর্যন্ত পাড়ার মুসলমানেরা। তাদের প্রায় তিরিশ জনের একটি দল সঙ্গে সঙ্গে চলে ১২ কিলোমিটার পথ, সীমান্ত পার করে দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যায়। তার কিছু দিন বাদে, আমাদের হালের বলদ গাই বাছুর সব নিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই যুদ্ধের মাঝে ত্রিপুরার বিশালগড়ে পৌঁছে দেয় তাদের প্রতিবেশী মুসলমানেরা । ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দেশ স্বাধীন হয়। জীবনেরা ফিরে যায়। গিয়ে দেখে উঠোনে ধানের পারা। ঘর মেরামতির কাজে প্রতিবেশী মুসলমানেরা হাত লাগায়। যে যা জিনিস নিয়ে গেছিল সব ফেরত আসে একে একে। ছন্দে ফেরে জীবন, কত প্রাণ গেছে তবু স্বাধীন মাতৃভূমির আনন্দে মেতে ওঠে জীবন।

অবশেষে নাপাক হানাদার আসে চান্দলায় হত্যা লুণ্ঠন আর আগুন লাগায় বসতভিটায়। কিন্তু জ্বালিয়ে দিতে পারে না হাজার বছরের ইতিহাসে অর্জিত বাঙালির সুখ সম্প্রীতি। যা ছিল, আছে, আজও থাকবে জীবনের চান্দলায়।

শুধু বিদ্বেষ হিংসা ধর্মীয় উন্মাদনা অত্যাচারের কাহিনিই বিবৃত হয় তিলকে তাল করে। প্রেম সম্প্রীতি সুখের কথাগুলো বলে না। বিদ্বেষ হিংসা ভুলতে মৈত্রী বন্ধনে বন্ধুর হাতে হাত রাখে না। বলতে ভুলেই গেছি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ছন্দে, ‘‘আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক বিনা সুতোয় রাখি বন্ধনের কারিগর আমরা একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ মর্মের মধুকর আমরাই চিরন্তন কুশল সাধক।’’

ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE