Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Bangladesh

ফাঁসি হয়ে গেল ‘চট্টগ্রামের জল্লাদ’ মির কাসেমের

বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি হয়ে গেল চট্টগ্রামের কসাই মির কাসেম আলির। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ বাস্তবায়িত হল শুক্রবার রাতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২২:০৮
Share: Save:

বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি হয়ে গেল চট্টগ্রামের কসাই মির কাসেম আলির। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ বাস্তবায়িত হল শুক্রবার রাতে। ফাঁসি হওয়ার পরেই ঢাকা, চট্টগ্রাম-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ মিছিল বেরোয়।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতের নেতা মির কাসেম ছিলেন দলের মূল অর্থ যোগানদাতা। একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামি ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ছিলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর নৃশংসতা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়।

মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে ১৯৭১ সালে মির কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলের নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরে সেখানে নির্যাতনের শিকার আরও পাঁচ জনের মৃতদেহের সঙ্গে জসিমের দেহকেও কর্ণফুলি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। মির কাসেমের নির্দেশেই আলবদররা চট্টগ্রামের হাজারি গলির ১৩৯ নম্বর বাড়ি থেকে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। এ সমস্ত অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় আদালত। ঢাকার কাছে গাজিপুরে কাশিমপুর জেলের সুপার প্রশান্তকুমার বণিক এ দিন রাতে ফাঁসি কার্যকরের কথা নিশ্চিত করেছেন।

ফাঁসির সরকারি হুকুমনামা এ দিন দুপুরেই পৌঁছে যায় জেলে। সন্ধের পরই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, আইজি প্রিজন এবং সিভিল সার্জেন কাশিমপুর জেলে আসেন। তৈরি হয়ে নেন ফাঁসুড়ে শাহীন, রিপন, সাজাহান, দীন ইসলাম। এ সব প্রস্তুতির মধ্যেই আজ বিকেলে জীবিত অবস্থায় মির কাসেমকে শেষ দেখা দেখে যান পরিবার পরিজনেরা। বিকেল সাড়ে ৩টেয় ছ’টা গাড়িতে করে জেলে পৌঁছন ৪৭ জন। তাঁদের মধ‌্যে মির কাসেমের স্ত্রী, কন্যা-সহ ৩৮ জনকে ভেতরে গিয়ে দেখা করতে দেওয়া হয় তাঁর সঙ্গে। অতীতে পাঁচ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর সাজা কার্যকর হয়েছিল আত্মীয়স্বজনরা দেখা করে যাওয়ার দিনেই। মির কাসেমের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হল।

গত মঙ্গলবার ‘চট্টগ্রামের জল্লাদ’ নামে পরিচিত, জামাতে ইসলামির শীর্ষ নেতা, মির কাসেম আলির মৃত্যুদণ্ড খারিজের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ আপিল বিভাগ। এর পর নিজের দোষ কবুল করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগটুকুই ছিল কাসেমের। কিন্তু শুক্রবার তিনি জানিয়ে দেন প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না। তার পরই সরকার ও প্রশাসনিক স্তরে শুরু হয়ে যায় প্রাণদণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি।

সামান্য এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান জামাতের এই নেতার সম্পদের পরিমাণ ছিল কম করে ১২ হাজার কোটি টাকা। ইসলামি ব্যাঙ্ক, ইবনে সিনা, দিগন্ত টেলিভিশন, নয়া দিগন্ত সংবাদপত্র-সহ অন্তত একশো বাণিজ্য সংস্থার মালিক মির কাসেম আলি। যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচার বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি মার্কিন ল’ফার্মকে তিনি ২৭৫ কোটি টাকা দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন বলে অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা অঞ্চলের ডালিম হোটেলে মির কাসেম আলির বাহিনী দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন করে খুন করেছে অজস্র মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘুকে। এই হোটেলে নির্যাতিতদের সাক্ষ্যই দীর্ঘ সাড়ে চার দশক পরে ফাঁসির দড়ির পড়িয়ে দিল পাক সেনাদের তৈরি আল বদর বাহিনীর কম্যান্ডার মির কাসেম আলিকে।

কারাগারের সামনে জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

পাকিস্তান আমলে চন্দ্রমোহন নাথের তৈরি ‘মহামায়া ভবন’টি দখল করে ডালিম হোটেল পত্তন করেছিলেন জামাতের তত্কালীন ছাত্র নেতা মির কাসেম আলি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পরে এই হোটেলকেই নির্যাতন ও মৃত্যুর কারখানা হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা আদালতে জানিয়েছেন, হুডখোলা জিপে চড়ে চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়াত কাসেমের সশস্ত্র বাহিনী। তালিকা ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলে এনে নগ্ন করে নির্যাতন করা হতো। শেষে তাদের খুন করে দেহ ফেলে দেওয়া হতো জলা-জঙ্গলে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কাসেম ও তাঁর বাহিনী পালিয়ে গেলে স্থানীয় মানুষ হোটেলটি থেকে বন্দিদের উদ্ধার করেন। চট্টগ্রামে আল শামস ও রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বেও ছিলেন এই কাসেম।

আরও পড়ুন: এই ডালিম হোটেলই ছিল ‘চট্টগ্রামের জল্লাদের’ মৃত্যুর কারখানা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে গা-ঢাকা দেওয়া মির কাসেম ১৯৭৭-এ ফের প্রকাশ্যে আসেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের বদান্যতায়। সৌদি দূতাবাসে চাকরি শুরুর পরে একের পর এক এনজিও খুলে কোটি কোটি ডলার বিদেশি সাহায্য তিনি কামাতে থাকেন বলে অভিযোগ। ১৯৮৩ সালে এরশাদের আমলে ‘ইসলামি ব্যাঙ্ক বাংলাদেশ’ পত্তন করে শিল্পপতি হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা ব্যবসায় নেমে গড়ে তোলেন ইবনে সিনা ট্রাস্ট। গড়ে তোলেন বাংলাদেশের সব চেয়ে আধুনিক ছাপাখানা। একই সঙ্গে জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হন মির কাসেম আলি।

জামাতে ইসলামির বিপুল অর্থের জোগানদার ছিলেন এই নেতা। শুনানি চলার সময়ে দেশের অর্থনীতিতে মির কাসেমের অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শাস্তি কমানোর আর্জি জানিয়েছিলেন তাঁর আইনজীবীরা। কিন্তু সে আর্জি আমল দেয়নি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE