Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অনেকেই ফিরবে না, বলছেন রোহিঙ্গারা

বললেন, ‘‘গেলে আবার তো অত্যাচারের মুখে পড়ব। মেয়ে-বউদের বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যাবে। দেখবেন, অনেকেই আর ফিরবে না!’’

অনিশ্চিত: ছেলেদের নিয়ে মদিনা বিবি। —নিজস্ব চিত্র।

অনিশ্চিত: ছেলেদের নিয়ে মদিনা বিবি। —নিজস্ব চিত্র।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কক্সবাজার শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:০৭
Share: Save:

ওঁরা যাতে ছেড়ে আসা ভিটেয় ফিরতে পারেন, তার জন্য সবাই চেষ্টা করছেন। ওঁদের ফেরত নিতে মায়ানমারের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে। কিন্তু কিছুতেই ফিরতে চান না মদিনা বিবি, ফতেমা, আনিসুর রহমান, মহম্মদ নিজামেরা।

ওঁরা সবাই রোহিঙ্গা শরণার্থী। উখিয়া ত্রাণ শিবিরে পাহাড়ের গায়ে নতুন বসানো রিগ টিউবয়েলে কাপড় কাচতে এসেছিলেন মদিনা বিবি। সঙ্গে দুই মেয়ে এক ছেলে। তাঁদের ফেরাতে সবাই যে ভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন, তাতে হতাশই ১০ সন্তানের মা মদিনা। বললেন, ‘‘গেলে আবার তো অত্যাচারের মুখে পড়ব। মেয়ে-বউদের বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যাবে। দেখবেন, অনেকেই আর ফিরবে না!’’

এই প্রতিবেদককে সরকারি অফিসার ভেবে দুই কিশোরী মেয়ে ফতেমা ও আসমত আরাকে দেখিয়ে মায়ের আর্জি, ‘‘আমাদের আর ফিরতে বলবেন না স্যর। মেয়ে দুটোকে আর বাঁচানো যাবে না।’’ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বাজিদং গ্রামে থাকতেন মদিনারা। শুনেছেন সে গ্রামের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার পরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেনা। মায়ের কথায়, ‘‘এই দুই মেয়েও হামলাবাজদের নজরে পড়েছিল। ওদের স্কুলেই পাঠাতে পারিনি।’’

কুলুং গ্রামে তাঁর টলটলে পুকুরের কথা ভেবে মন হু-হু করে ওঠে ৭০ বছরের মহম্মদ নিজামের। ‘‘মাছের চাষ করতাম। চোখ বুজলে দেখতে পাই, পুকুরে মাছ লাফাচ্ছে। ওই পুকুরের জন্যই ফিরতে চাই।’’ লুঙ্গির খুঁট দিয়ে চোখ মুছে নিজাম বলেন, ‘‘ফিরতে তো চাই, কিন্তু ভয় যে যায় না। ওরা বাড়ি থেকে ডেকে এনে গ্রামের বাইরে দাঁড় করিয়ে দিল। দেখি, পিছনে গোটা গ্রাম জ্বলছে! বয়স হয়েছে বলে প্রাণে মারেনি। এ বার গেলে আর ছাড়বে না।’’

উখিয়ায় পাহাড়ের গায়ে থাক থাক অস্থায়ী শিবিরে নিজামদের কেউ রয়েছেন ছ’মাস, কেউ বা আট মাস। এ ক’মাসে হুটার বাজিয়ে, কনভয় নিয়ে বেশ কিছু লোককে তাঁরা শিবিরে আসতে দেখেছেন। প্রথমে লোকজন আসত, সাহায্য নিয়ে।
এখন যাঁরা আসেন, তাঁরা যাওয়ার পরে মিজানুরেরা জানতে পারেন, তাঁদের
ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে। উখিয়ায় তিন নম্বর শরণার্থী শিবিরে মিজানুর রহমানের ভূমিকা অনেকটা মুখিয়ার মতো। স্পষ্ট বলেন, ‘‘আমরা যে মায়ানমারের নাগরিক, সেই কাগজটা চাই। না হলে ফিরে লাভ নেই। অত্যাচার হলে অভিযোগ নেবে না পুলিশ। ফের এখানে আসতে হবে।’’ গোটা
শিবিরে সেই আশঙ্কারই প্রতিধ্বনি।

উখিয়ার পাঁচটি শিবিরের দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট শামিমুন হক বলছিলেন, ‘‘এখন পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। খাওয়াদাওয়ার অভাব নেই। অস্থায়ী হাসপাতাল, স্কুল আছে। এখন আমাদের কাজ, ওঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।’’

ত্রাণ শিবিরের মধ্যেই দোকান খুলেছেন আনিসুর রহমান। ডালমুট, বিস্কুট, লজেন্স, পেঁয়াজ, আদা, সুচ-সুতো, কাটা-ছেঁড়ার মলম বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এ সব কেনার টাকা কোথায় পেলেন তিনি? পাশ থেকে হামিদ হুসেন বলেন, ‘‘লাগবে এক বোতল তেল। পাচ্ছি তিন বোতল। খাবারও দিচ্ছেন অনেকে। সে সব বিক্রি করে আনিসুরের মতো দোকান খুলেছেন অনেকেই। রোজ ডিম-ভাত খেতে ভাল লাগে? তাই বাড়তি তেল, ডিম, বিস্কুট বাজারে বিক্রি করে কেউ মাছ কিনছি, কেউ মুরগি।’’

শিবিরে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীর কথায়, ‘‘শুধু কি তেল-ডিম? বাজারে ঘুরলে দেখবেন বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রীও বাইরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি প্লাস্টিকের তৈরি অস্থায়ী শৌচাগারও!’’

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rohingya Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE