২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের প্রাক্কালে আমার ভেতরে কিছু মিশ্র অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে। মোহিত মৈত্র মঞ্চে এই ২১ তারিখ সম্পূর্ণ নতুন একটি স্পেসে আমার একটি নতুন নাট্য প্রযোজনা নামতে যাচ্ছে। নাটকটি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে রচিত, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। প্রযোজনা পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ-র। নাটকটি বারবধূ-খ্যাত (নাকি কু-খ্যাত) নির্দেশক অসীম চক্রবর্তীর জীবন অবলম্বনে আধারিত। অভিনয় করছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, সত্রাজিৎ সরকার, অঙ্কিতা মাঝি, ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ। নাটকটি আমি পরিমার্জনা করেছি এবং নির্দেশনার দায়িত্ব আমার। অসীম চক্রবর্তী ‘নাকি’ বাংলায় প্রথম ব্রেশট করেছিলেন। কেউ কিছু বলেনি, মনেও রাখেনি। অসীম চক্রবর্তী ‘নাকি’ বাংলায় প্রথম আর্থার মিলার করেছেন, কেউ কিছু বলেনি, মনেও রাখেনি। তিনিই প্রথম ‘নাকি’ দস্তয়ভস্কি আর আলবেয়ার কামুকে বাংলা মঞ্চে নিয়ে আসার দুঃসাহসিক এক নিরীক্ষা করেছিলেন। কেউ কিছু বলেনি, মনেও রাখেনি। কিন্তু তিনি যে মুহূর্তে সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে বাংলা মঞ্চে প্রথম ‘বারবধূ’ করলেন, লোকে তাঁর অনেক নিন্দা করল, তাঁকে একঘরে করল এবং অবশেষে শুধুমাত্র ‘বারবধূ’র মধ্যে দিয়েই তাঁকে মনেও রাখল। তাঁর নাট্যদল ‘চতুর্মুখ’ নিন্দিত হল একটি বাংলা নাটক করার অপরাধে। এমনকী, ১৯৮০-তে তৎকালীন এক মন্ত্রী ‘বারবধূ’ না করার জন্য লিখিত ফতোয়াও দিলেন। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানিয়ে রাখা ভাল, ‘বারবধূ’ চলেছিল দেড় হাজার নাইট, প্রত্যেকটি হাউসফুল ছিল। এক গবেষক উপমা দিয়ে বোঝাচ্ছেন, এমন কোনও সিনেমা দেখাতে পারেন, যা নন্দনেও হাউসফুল আবার খান্নাতেও হাউসফুল? ‘বারবধূ’র ক্ষেত্রে এই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটেছিল। সেটি অ্যাকাডেমি, কলামন্দিরেও হাউসফুল ছিল, আবার প্রতাপ মঞ্চেও হাউসফুল ছিল। গবেষকের অনুমান, তার মানে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ ১৯৭২ থেকে ’৮০ পর্যন্ত চলা এই থিয়েটারটি দেখেছিলেন। গবেষকের নাম অসীম সামন্ত। তাঁর বইটির নাম ‘জনৈক অসীম চক্রবর্তী সম্পর্কে দু একটি কথা’।
অনেকেই বলবেন, ‘বারবধূ’তে নিষিদ্ধ বা তথাকথিত অশ্লীল কিছু ছিল তাই এই ভিড়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু প্রফেশনাল থিয়েটারে অ্যাডাল্ট মার্কা থিয়েটার করা হয়েছিল, যার বিজ্ঞাপনে ‘কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ ইত্যাদি লোভনীয় শব্দবন্ধ থাকত। এবং সে সবে নাকি বিকট ভাবে ক্যাবারে নাচ দেখানো হত। নারীদেহও দেখানো হত। কিন্তু সেগুলির কোনওটাই ‘বারবধূ’র মতো চলেনি। তার মানে ‘বারবধূ’র মধ্যে ‘ব্লোহট নাটক’ শব্দটির অতিরিক্ত কিছু ছিল। তা না হলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে শুরু করে উত্তমকুমার, শিবনারায়ণ রায় থেকে শুরু করে অম্লান দত্ত পর্যন্ত বিদগ্ধ মানুষেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন না। ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই ছোট মেয়েকে নিয়ে নাটকটি দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি তো আপত্তিকর কিছু পানইনি, বরং তাঁর মনে হয়েছিল, এ এক মানবজীবনের মর্মন্তুদ হাহাকারের কাহিনি। তা সত্ত্বেও অসীম চক্রবর্তী সম্পর্কে সাধারণ বাঙালির ছুঁৎমার্গ রয়েই গেল। সেই ছুঁৎমার্গে রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ছিল ১৯৮০ সালে মন্ত্রীর ওই ফতোয়া। এর এক-দু’বছরের মধ্যে অসীমবাবু মারা যান শোকে-তাপে-বেঘোরে। তাঁর থেকে উপকার নেওয়া বন্ধুরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন, খারাপ কথা বলেছিলেন এবং তাঁর শেষকৃত্যে কেতকী দত্ত ছাড়া আর কোনও বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব যাননি। অর্থাৎ, অসীম চক্রবর্তী ছিলেন গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম ‘আউটকাস্ট’, প্রথম ব্রাত্য। মাইনরিটি কালচারের মধ্যেও প্রথম মাইনরিটি। প্রান্তিকদের মধ্যে প্রান্তিকতম। তাঁর প্রান্তিক শিল্পের বন্ধুরাই তাঁকে একঘরে করেছিলেন।
কী ছিল অসীমের অপরাধ? অপরাধ এটাই, অসীমের থিয়েটার লোকে বেশি দেখেছিল। বড় মিডিয়া পাশে না থাকা সত্ত্বেও। তিনি ছিলেন, যাকে বলে সুপার ডুপার হিট। তার মানে দাঁড়ায়, যখন তিনি মিলার বা ব্রেশট করলেন, গণমানুষ না বোঝার কারণে সেগুলো তেমন দেখল না। আর বাংলা গল্প থেকে তিনি যখন বাঙালি নাটক করলেন (মৌলিক বাংলা ভাষার নাটক) তখন তাঁর কপালে জুটল সামাজিক নিন্দা ও রাজনৈতিক ফতোয়া। ভাষা যদি সংস্কৃতির বাহন হয়, তা হলে বলতেই হবে, যে প্রেক্ষিত অসীমের সময়ে বিদ্যমান ছিল, এখনকার বাঙালি সমাজে তার বিশেষ কোনও ফারাক ঘটেনি। যে ভাষায় কথা বলে নাকি পৃথিবীর ৩০ কোটি মানুষ, ২১শে ফেব্রুয়ারির শুরুতে তার ভাষাগত মর্যাদা যদি বাড়াতে হয় তা হলে অসীমদের কাহিনি বার বার আমাদের স্মরণে আনা উচিত। এবং এক নতুন মূল্যায়নে বসা উচিত। নইলে নতুন সাংস্কৃতিক দিশা, ভাষাগত মর্যাদার উত্তরণ ইত্যাদি শব্দবন্ধ গালভরা বুকনি হয়েই থেকে যাবে। সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষার মর্যাদা আরও কমতে থাকবে, কমতেই থাকবে।
এই থিয়েটারটি আমরা করছি মোহিত মৈত্র মঞ্চে, এটি টালা পার্কের কাছে পাইকপাড়ায় (যার কাছে নর্দার্ন অ্যাভিনিউতে অসীম থাকতেন)। এটি একটি আধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ। এখানে আধুনিক থিয়েটারের সমস্ত উপকরণ রয়েছে। অসীমেরা এ সুবিধা পাননি। এ সুবিধা আমরা পাচ্ছি। গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি ভাল বাংলা থিয়েটার করার নতুন স্পেস তৈরি হয়েছে, যা আমাদের বাংলা ভাষার পক্ষে ভাল লক্ষ্মণ। কিন্তু থিয়েটার দেখার সাবেকি অভ্যাস ছেড়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শক কি ঝুঁকি নেবেন নতুন আধুনিকতাকে বরণ করে নেওয়ার? কেননা, নতুনকে গ্রহণ করার মধ্যে যে আধুনিক মন লাগে তা কি সত্যিই আমরা অর্জন করে উঠতে পেরেছি, এখনও?
২১শে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এই কথাগুলিই আমাকে ভাবাচ্ছে।
(ব্রাত্য বসু নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy