Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিমার নির্ঘণ্ট

নিখুঁত লাইন, লেংথে ছুটে আসছে বল। সময়ে থামাতে না-পারলে আউট হওয়ার আশঙ্কা। ফিরতে হবে প্যাভিলিয়নে। জীবনেও কিন্তু আঘাত আসতে পারে হঠাৎ করে। তা সামলাতে ঠিক সময়ে বিমার বর্ম পরতে বললেন ভরত কলসিপরিবারের জন্য বেশি অঙ্কের বিমা করা যেমন জরুরি, তেমনই ঠিক সময়ে বিমা কেনাটাও আর্থিক পরিকল্পনার অঙ্গ। কিন্তু কী ভাবে বুঝব কোন সময়টা ঠিক? জীবনের প্রতিটি পরিকল্পনাকে বিমার সুরক্ষাই বা দেব কী ভাবে? আজকের আলোচনা তা নিয়েই।

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:১৩
Share: Save:

মাথার উপরে হঠাৎ করে ব্রিজ ভেঙে পড়া আগাম আঁচ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এ রকম কোনও দুর্ঘটনায় যাতে পরিবার ভেসে না যায়, সে জন্যই রয়েছে জীবন বিমা। কিন্তু ঠিক সময়ে সেই বিমা না করলে, তা আর্থিক পরিকল্পনার বারোটা বাজাতে পারে। অথচ দেখা যায়, আর পাঁচটা জায়গায় টাকা রাখার সময়ে আমরা যতটা ভেবেচিন্তে মাঠে নামি, বিমার বেলা সেই সচেতনতা যেন কিছুটা কম। তাই অনেক সময়েই যখন দরকার তখন হয় কোনও বিমা থাকে না। অথবা থাকলেও তার অঙ্ক প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। কিন্তু তার জন্যই গুনে চলা গুচ্ছ প্রিমিয়াম।

পরিবারের জন্য বেশি অঙ্কের বিমা করা যেমন জরুরি, তেমনই ঠিক সময়ে বিমা কেনাটাও আর্থিক পরিকল্পনার অঙ্গ। কিন্তু কী ভাবে বুঝব কোন সময়টা ঠিক? জীবনের প্রতিটি পরিকল্পনাকে বিমার সুরক্ষাই বা দেব কী ভাবে? আজকের আলোচনা তা নিয়েই। শুরু করব একেবারে গোড়ার কিছু কথা দিয়ে।

বিমা করা কেন?

পরিবারের রোজগেরে মানুষটির অবর্তমানে সংসার চালাতে যাতে অসুবিধা না হয়, সন্তানদের পড়াশোনা পয়সার অভাবে আটকে না যায়, সে জন্যই জীবন বিমা করার কথা বলা হয়। অর্থাৎ, আপনার সমস্ত দায়কে সুরক্ষার কবচ পরানোর পদ্ধতিই হল বিমা।

কত টাকার?

মানুষের প্রয়োজন, মাইনে, জীবন যাপনের ধরন ইত্যাদি মাথায় রেখেই বিমার অঙ্ক স্থির করতে হয়। তাই বিমা করার আগে দেখুন—

• সংসারে টাকা দেন কি না। দিলে কতটা।

• বাড়ি, গাড়ি কেনার মতো কোনও ঋণ রয়েছে কি? থাকলে তার অঙ্ক কত, কত দিন কিস্তি বাকি ইত্যাদি।

• বিয়ের পরিকল্পনা করছেন কি না।

• বিয়ের পরে সন্তানের জন্য তৈরি হলে, ভবিষ্যতে তার শিক্ষা ও বিয়ের খরচ।

এ বার সমস্ত দায় ধরে নিয়ে তবেই স্থির করতে হবে বিমার অঙ্ক। মনে রাখতে হবে, জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এখনকার বিমা আগামী দিনে যথেষ্ট হবে না। তাই বিমার অঙ্ক স্থির করার সময়ে অবশ্যই মূল্যবৃদ্ধি হিসেব করুন।

কখন করব?

চাকরিতে ঢোকার পরেই প্রথম লগ্নি হিসেবে বিমা আমরা অনেকেই করি। কিন্তু সেটা ঠিক পদ্ধতি নয়। কারণ, বিমা করলেই হল না, কেন বিমা করছেন সেটা প্রথমে জানা জরুরি। সেই অনুসারে কোন সময়ে বিমা করবেন তা ঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে সময় ঠিক করার সবচেয়ে সোজা পদ্ধতি হল আপনার কোনও দায়-দায়িত্ব রয়েছে কি না, তা আগে থেকে স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া। আর তার পরে বিমা করা।

এ জন্য সাধারণত দু’টি অবস্থার কথা ভাবতে বলা হয়— প্রথম, বিয়ের আগে। আর দ্বিতীয়, বিয়ের পরে।

বিয়ের আগে

এটা ঠিক যে বিয়ের আগে তুলনায় দায়িত্ব অনেকটা কম থাকে। কিন্তু তা-ও অনেক ক্ষেত্রেই সংসার চালানোর খরচ কাঁধে নিতে হয়। আবার চাকরি পাওয়ার পরেই গাড়ি-বাড়ি কেনার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। সেটাও কিন্তু আর্থিক দায়। যেখানে ঋণগ্রহীতার অবর্তমানে কিস্তির টাকা জোগাড়ে সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে—

• সংসারের দায়িত্ব কাঁধে থাকলে নিজের জন্য বড় অঙ্কের জীবন বিমা করুন।

• বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনে থাকলে, সে ক্ষেত্রে আলাদা জীবন বিমার ব্যবস্থা করুন।

বিয়ের পরে

মানুষের জীবনে বিয়ে একটা সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু তার সঙ্গেই দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকটাই। তখন সংসার খরচ সামলানোর পাশাপাশি, সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও বিয়ে, অবসর জীবনের মতো অনেক কিছুর জন্য ভাবনাচিন্তা করতে হয়। যে কারণে আগে থেকে না থাকলে, আপনার সমস্ত আর্থিক দায়কে বিমার ছাতার তলায় আনার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে বিয়ে ঠিক হলে বা বিয়ের পরেই।

সন্তানের জন্য

আমাদের মধ্যে প্রবণতা থাকে ছেলেমেয়ে হওয়ার পরে, তার নামেও বিমা কেনার। কিন্তু তা ভাল পরিকল্পনার লক্ষণ নয়। বরং তার পড়াশোনা ও বিয়ের মতো পরিকল্পনাকে সুরক্ষিত রাখতে বিমা করতে হবে বাবা-মায়ের নামে। যাতে তাঁদের কিছু হলে সন্তানের বেড়ে ওঠার পথে অর্থের সমস্যা না হয়।

এ জন্য মাথায় রাখুন—

• অনেক বিমা পলিসি রয়েছে, যেগুলিতে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমামূল্য বাড়ে। চাইলে সেই পলিসি বেছে নিতে পারেন।

• যদি এই ধরনের পলিসি কিনতে না চান, তা হলে সন্তান জন্মের পরে বিমামূল্য বাড়াতে হবে। সে জন্য চাইলে আলাদা একটি পলিসি কিনতে পারেন অথবা চালু পলিসির বিমামূল্য বাড়াতে (টপ-আপ) পারেন।

• অনেক ক্ষেত্রে আবার এমন জীবন বিমা প্রকল্প পাওয়া যায়, যেগুলিতে বাবা-মায়ের অবর্তমানেও প্রিমিয়াম বন্ধ হয় না।

বাড়ি ঋণের জন্য জীবন বিমা

মাথায় ছাদ জোগাড়ের পরিকল্পনা করে থাকলে তো কথাই নেই। বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার খরচ বিপুল। তার জন্য মাসে মাসে মোটা কিস্তিও গুনতে হয়। রোজগেরে মানুষটির অবর্তমানেও যাতে সেই মাসিক কিস্তির টাকা বন্ধ না হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।

এর ভাল উপায় হল, ঋণগ্রহীতার নামে আলাদা একটি টার্ম পলিসি কেনা। এখন অনেক ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের ঋণ নেওয়ার সময়েই বিমা করায় ঋণদাতা সংস্থা বা ব্যাঙ্কগুলি। কিছু ক্ষেত্রে সেই বিমার অঙ্ক, ঋণ শোধের সঙ্গেই ধাপে ধাপে কমে আসে। এর সুবিধা হল, আপনাকে আলাদা করে বিমা করাতে হল না। অথচ ভবিষ্যতে দুর্ঘটনায় ঋণের কিস্তি বন্ধ হওয়া বা বাড়ি-ফ্ল্যাট হাতছাড়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

যত আগে তত ভাল

দায়িত্ব না থাকলে বিমা করতে দেরি করতে পারেন। কিন্তু যদি প্রয়োজন থাকে, তা হলে যত আগে বিমা কিনবেন, তত ভাল। এতে এক দিকে প্রিমিয়াম তুলনায় কম পড়বে। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও মিলতে পারে। একটা উদাহরণ দিই—

ধরুন, কেউ ৩০-৩৫ বছর বয়সে বিমা করছেন। তিনি সিগারেট খান না। সে ক্ষেত্রে ১ কোটি টাকার টার্ম পলিসির জন্য তাঁর প্রিমিয়াম পড়বে প্রায় ৮,০০০ টাকা।

কিন্তু সেই ব্যক্তিই যদি ৪৫ বছরে গিয়ে বিমা করান, তা হলে ওই একই অঙ্কের বিমা কিনতে প্রিমিয়াম দিতে হবে ২০,১০০ টাকা।

অর্থাৎ, যত অপেক্ষা করবেন, সমস্যা আপনারই। তার উপরে খুব বেশি দেরি করলে শরীরের সমস্যা এবং বয়সের কারণে বিমা করাতে রাজি না-ও হতে পারে অনেক সংস্থা। তাই দায়িত্ব কাঁধে এলেই বিমা করুন।

কত দিনের

অনেকেই জানতে চান, কত দিনের জন্য জীবন বিমা করা উচিত। দেখুন বিমা করার অন্যতম লক্ষ্য হল, রোজগেরে না থাকলেও যাতে কোনও কিছু না আটকায়। এ জন্যই কমপক্ষে চাকরি জীবনের মেয়াদ পর্যন্ত বিমা করার কথা বলা হয়। সাধারণত দেখা যায়, ৫৫-৬০ বছরের মধ্যে বাড়ি-গাড়ি কেনা, সন্তানের উচ্চশিক্ষা, বিয়ের মতো কাজের জন্য টাকা লাগে। তাই কমপক্ষে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বিমা থাকা অবশ্যই জরুরি।

শেষপাত

জীবনের ঝড়-ঝাপ্টা যাতে আপনার কাছের মানুষের গায়ে না লাগে, সে জন্যই বিমা। তাই প্রতিটি ধাপে যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন, তার গায়ে বিমার সুরক্ষাকবচ পরানোর দায়িত্বও আপনারই। এখানে শুধু কিছুটা সেই পথে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম আমরা।

ছবি: ফাইল চিত্র

লেখক: টাটা এআইএ লাইফ

ইনশিওরেন্সের চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার

(মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Insurance Policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE