Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তো সন্ধান

শেয়ার বাজারের সমুদ্রে ওঠা-পড়ার নিরন্তর ঢেউ তো থাকবেই। কিন্তু তার মধ্যেও ডুব দিয়ে তুলে আনতে হবে মুনাফার মুক্তো। ঝুঁকি-রিটার্নের অতল সাগরে ডুব দেওয়ার তালিম দিলেন নীলাঞ্জন দেবাড়তি মুনাফার কড়ি ঘরে তুলতে কিছুটা ঝুঁকি তো নিতেই হবে। তাই যদি এই সমুদ্রে ডুব দেবেন বলে ভেবে থাকেন, তবে ঘাবড়ালে চলবে না। সাবধানে পা যেমন ফেলতে হবে, তেমনই জানতে হবে সাঁতারও।

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:৩৭
Share: Save:

এই মন ভাল করা রোদ তো পরক্ষণেই বৃষ্টি। প্রকৃতির এই অনিশ্চয়তার প্রতিফলন যেন শেয়ার বাজারেও। যেমন ধরুন, কিছু দিন আগে সেনসেক্স পেরিয়েছিল ৩৮ হাজারের মাইলফলক। তখন অনেকেই বলছিলেন, ‘‘আহা! ক’টা শেয়ার আগে কেন কিনিনি?’’ কিন্তু ক’দিন পরেই পাল্টে গেল ছবিটা। পড়তে শুরু করল সূচক। সেনসেক্স নেমে গেল ৩৪-৩৫ হাজারের ঘরে। তখন আবার কেউ হয়তো বললেন ‘‘ভাগ্যিস বাজারে ঢুকিনি!’’

কিন্তু এ ভাবে তো আর লগ্নির সিদ্ধান্ত হয় না। শুধু ঝুঁকিহীন আমানত দিয়ে আপনি মূল্যবৃদ্ধির অসুরকে হারাতে পারবেন কি? তাই সে দিক থেকে দেখলে শেয়ারকে একেবারে সরিয়ে রাখা যাবে না। বাড়তি মুনাফার কড়ি ঘরে তুলতে কিছুটা ঝুঁকি তো নিতেই হবে। তাই যদি এই সমুদ্রে ডুব দেবেন বলে ভেবে থাকেন, তবে ঘাবড়ালে চলবে না। সাবধানে পা যেমন ফেলতে হবে, তেমনই জানতে হবে সাঁতারও। বাজার তো আর বাড়ির কুয়ো নয়। ওঠা-পড়ার ঢেউ এখানে থাকবেই।

বাজারে নতুন

প্রথমেই বলি, বাজারে পাঁজি দেখে প্রথম পা ফেলা যায় না। ওঠা-নামা, অনিশ্চয়তা থাকবেই। তার মধ্যেই নেমে পড়তে হবে বুক ঠুকে। জানতে হবে বাজার সম্পর্কে। নিতে হবে ধৈর্য্য ধরার পাঠ। বুঝতে হবে কখন কোন শেয়ার কিনবেন বা বেচবেন। রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় অন্তত বাজারে পা রাখবেন না।

আজ যা উঁচু,কাল তা নিচু

সেনসেক্সকে ৩৮ হাজারে দেখে হয়তো মনে হয়েছিল বড্ড উঁচু। কিন্তু ভেবে দেখুন, একই কথা বিভিন্ন সময়ে মনে হয়েছিল ২৫, ৩০, ৩৪ হাজারেও। ফলে বাজার আর একটু পড়লে, শেয়ার কিনব, ভাবা অর্থহীন। কে বলতে পারে, চার-পাঁচ বছরে সূচক ৪০-৫০ হাজাের পৌঁছবে না? তখন ৩৪-৩৫ হাজার, এমনকি ৩৮ হাজারকেও তলানি মনে হবে।

সব শেয়ার ওঠে না

বাজারের সব শেয়ার একসঙ্গে ওঠে বা নামে না। বিভিন্ন কারণে কোনও সংস্থার শেয়ার দর বাড়ে, কোনওটির কমে। তার মধ্যে রয়েছে সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ, ব্যবসার সাফল্য, বিতর্কিত সিদ্ধান্তের মতো হাজারো শর্ত। দেশ-বিদেশের নানা ঘটনা, রাজনীতিও এতে ছাপ ফেলে। শেয়ার বাছাইয়ের সময়ে ওই সমস্ত বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি।

ঝুঁকি মেপে

মনে রাখবেন, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বাজারে লগ্নির ঝুঁকি মাপার অন্যতম ফিতে। কেন, কখন, কোন ধরনের শেয়ার কিনবেন, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই বাজারে পা রাখতে চাইলে এ ধরনের কিছু পরিস্থিতির বিষয়ে প্রাথমিক পাঠটুকু থাকা জরুরি। যেমন—

• ভোট নিয়ে অস্থিরতা: এখন চলছে বিধানসভা ভোট। আগামী বছর লোকসভা। দেখবেন, তা না হওয়া পর্যন্ত বাজার মোটের উপর অনিশ্চিত থাকবে। কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জয়ী দলের মতাদর্শ, সংস্কারের ইচ্ছে ইত্যাদি বাজারকে অবশ্যই প্রভাবিত করে। ফলে এই টালমাটালে ঘাবড়াবেন না।

• নগদ জোগানে আশঙ্কা: সম্প্রতি পরিকাঠামোয় ঋণদাতা আইএল অ্যান্ড এফএস-সহ বেশ কিছু এনবিএফসি (ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান) বাজার থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ও ঋণপত্রে সুদ মেটাতে না পারায় মূলধনী বাজারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, তাদের নগদ জোগানে টান। ফলে খুব পাকা খেলোয়াড় না হলে, ওই ধরনের সংস্থার শেয়ার কিছু দিন এড়িয়ে চলা ভাল।

• অর্থনীতির ভিত: ডলারে টাকার দাম বাড়ছে না কমছে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম উঠছে না নামছে, এ সবই বাজারের উত্থান-পতনের বড় নির্ধারক। কারণ এগুলির উপর অর্থনীতির ভাল-মন্দ নির্ভর করে। অনেক সময় নির্ভর করে কিছু কিছু সংস্থার লাভ-লোকসানের অঙ্কও। যেমন, ডলারে টাকার দাম পড়লে অনেক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার মতো রফতানিকারীদের পোয়াবারো। মাথায় হাত আমদানি নির্ভর সংস্থার।

আবার বিশ্ব বাজারে তেল দামি হলে ভারতেও পেট্রল, ডিজেলের দর বাড়ে। মূল্যবৃদ্ধির মাথা তোলার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতি জুঝতে অনেক সময়ে সুদ বাড়াতে পারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রে আবার আবাসন নির্মাণ, গাড়ির মতো সুদ নির্ভর ব্যবসা প্রমাদ গোনে।

তাই এ সব ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনায় কোন শেয়ার মার খেতে পারে, সেটা আগাম আঁচ করে তাকে কিছু দিন এড়িয়ে চলতে হয়। বা হাতে তার শেয়ার কেনা থাকলে, সুদিন ফেরার অপেক্ষা করতে হয়।

দুই অস্ত্র

বাজার আজ উঠছে তো কাল ফের নেমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি ছায়াসঙ্গী। তা সত্ত্বেও রিটার্ন ভাল পাওয়ার এটা মোক্ষম জায়গা। এখানে লগ্নিকারীর প্রধান অস্ত্র দু’টি। এক, ভাল সংস্থার শেয়ার বেছে নেওয়া। দুই, দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নি ধরে রাখা।

বড়-ছোট সবই থাকুক

সাম্প্রতিক কালে বেশির ভাগ সময়েই সূচককে বাড়তে দেখা গিয়েছে মূলত বড় কিছু সংস্থার হাত ধরে। যেগুলি নামী-দামি ব্লু-চিপ সংস্থা। শেয়ার মূলধনের বিচারে যেগুলিকে মাঝারি সংস্থা বা মিড-ক্যাপ বলা হয়, তাদের দর পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এতটাই যে, লগ্নিকারীদের একাংশ লোকসানে পড়েছেন। মার খেয়েছে বহু স্মল-ক্যাপ বা ছোট সংস্থার শেয়ার দরও। তা হলে প্রশ্ন হল, মাঝারি বা ছোট সংস্থার শেয়ার কি কিনবই না?

আমার জবাব, ভাল রিটার্ন পেতে হলে লগ্নির ঝুলিতে বড় সংস্থার পাশাপাশি মাঝারিগুলির শেয়ারও রাখতে হবে। ঠাঁই দিতে হবে ছোটদেরও। কারণ ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলির সামনে শেয়ার দর বৃদ্ধির সুযোগ অনেক বেশি থাকে। ফলে ঝুঁকি সামলে ভাল রিটার্ন পেতে সব কিছুই ঝুলিতে রাখতে হবে। শুধু শেয়ার বাছাই করতে হবে সতর্ক হয়ে। ভাল-মন্দের চুলচেরা বিচার করে।

আতসকাচের তলায়

শেয়ার পছন্দ করার রাস্তায় অনেকগুলি মোড় আছে। এক একটিতে দাঁড়িয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়, এখান থেকে রাস্তা কোন দিকে যেতে পারে? উপরে না কি নীচে! সেই মোড়ে কখনও আতসকাচ ধরতে হয় একটি সংস্থার উপরে। কখনও একই সঙ্গে নেড়েচেড়ে দেখতে হয় এক বা একাধিক শিল্পের বিভিন্ন সংস্থাকে। বুঝতে হয় বাকি সংস্থার সংস্থার তুলনায় আপনারটি কোথায়? কখনও আবার রাজনীতি-অর্থনীতিতে ঘটে যাওয়া নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে যাচাই করতে হয় বিভিন্ন সংস্থার অবস্থান, ভবিষ্যতে তার এগোনোর দিশা, সমস্যা মোকাবিলার ক্ষমতা হিসেবে ভাঁড়ারের অস্ত্রসম্ভার।

পুরনো যাঁরা

শেয়ার বাজারে পোড় খাওয়া জনও অস্থির বাজারে অনেক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নাস্তানাবুদ হন। ধন্দ তৈরি হয়, কোন শেয়ার কিনবেন, রাখবেন, বেচবেন তা নিয়ে। আমি বলব, বাজারে প্রথম পা ফেলার জন্য যে সব দিকে খেয়াল রাখতে বললাম, সেগুলিতে আপনাকেও চোখ রাখতে হবে। সঙ্গে মনে রাখতে হবে—

• হাতে থাকা কোন শেয়ারগুলির অবস্থা শোচনীয়, প্রথমে তা বেছে ফেলুন। এখন দাম তলানিতে মানেই যে পরে তা উঠবে না, এমন নয়। কিন্তু দেখা দরকার, যে মেয়াদের কথা আপনি ভাবছেন, সত্যিই তার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ওই শেয়ারের আছে কি না।

• খতিয়ে দেখুন, সংস্থার শেয়ারের এই পতন কি সাময়িক? না কি সংস্থার অসুখ আরও গভীরে?

• সংস্থার আর্থিক ফলাফল ভাল হয়েছে বা হচ্ছে তো?

• ফল যদি ভাল না হয়, তা হলে কি সেটা শুধু এই সংস্থাটির? না কি সামগ্রিক ভাবেই শিল্পের ফল খারাপ?

• সংস্থা ও শিল্পের আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কতটা?

• সংস্থা পরিচালনা কতটা শক্তিশালী? কঠিন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর রেকর্ড তাদের আদৌ আছে কি? নেতৃত্ব কেমন?

অনেক সময়ে দেখেছি, হাতে থাকা শেয়ারের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন লগ্নিকারী। হয়তো বিস্তর খেটে অনেক তথ্য নাড়াচাড়ার পর তবে ওই সংস্থার শেয়ার কিনেছিলেন। কিংবা কোনও কারণে তাঁর অগাধ আস্থা সংস্থার প্রতি। সাধারণত এই সমস্ত ক্ষেত্রেই কোনও শেয়ারের প্রতি দুর্বলতা জন্মায়। কিন্তু এটা মারাত্মক ভুল।

দেখুন, বাজারে সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। সুতরাং ডুবে যাওয়া শেয়ারকে অযথা ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ বানাবেন না। বরং মেনে নিন যে, বাছাইয়ে ভুল হয়েছিল। দেখবেন, তা হলে ওই শেয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার জায়গা অন্তত শেয়ার বাজার নয়।

সুতরাং...

শেয়ার বাজারে অনিশ্চয়তা থাকবেই। সব সময়। এক দিন সূচক ১০০ পয়েন্ট উঠল, তো পরের দিনই ২০০ পয়েন্ট পড়ে গেল। বাজার সাধারণত এ ভাবেই চলে। ফলে তা মেনে নিয়েই কিন্তু এগোতে হবে আপনাকে। মনে রাখবেন, বাজার প্রতিদিনই লগ্নির সুযোগ দেবে। কিন্তু তাতে রিটার্নের হাতছানি যেমন থাকবে, তেমনই থাকবে ঝুঁকিও। তাই কতটা ঝুঁকি নিতে চান, তা শুরুতে মোটামুটি ভেবে নিয়ে তবেই এই জগতে পা রাখুন।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Share Market Investment Profit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE