Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আইনি অস্ত্রে হস্তক্ষেপ পটেলের এক্তিয়ারেও! উর্জিত-প্রশ্নে আরও অনড় মোদী সরকার

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৮৩ বছরের ইতিহাসে যে আইন কখনও কাজে লাগানো হয়নি, তাকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে তার কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

উর্জিত পটেল প্রসঙ্গে অনড় অবস্থান নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ছবি: পিটিআই।

উর্জিত পটেল প্রসঙ্গে অনড় অবস্থান নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৪৩
Share: Save:

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজে নাক গলানোর অভিযোগে পিছু হটা দূরের কথা। আরও অনড় অবস্থান নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৮৩ বছরের ইতিহাসে যে আইন কখনও কাজে লাগানো হয়নি, তাকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে তার কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ হেন অভিযোগ ওঠার পরে, কার্যত তা স্বীকার করে নিয়েই অর্থ মন্ত্রক জানিয়ে দিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকার তার মতামত জানায়। কোনও সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানও বাতলে দেয়। সরকার ভবিষ্যতেও তা করতে থাকবে।

এর পরে উর্জিত পটেল আর গভর্নরের পদে থাকবেন কি না, কবে তিনি পদত্যাগ করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদত্যাগের জল্পনার ধাক্কায় আজ টাকার দাম পড়েছে। শেয়ার বাজারের সূচকও পড়েছে। তা সামাল দিতে অর্থ মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতাকে সম্মান জানায়। তা পালনও করে। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের যুক্তি, সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আইনের ৭ নম্বর ধারার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে তার কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। শুধু আলোচনা শুরু করা হয়েছে।

ধারা ৭

• শীর্ষ ব্যাঙ্ক স্বশাসিত সংস্থা হলেও প্রয়োজনে কেন্দ্র তার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। ১৯৩৪ সালের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ৭ নম্বর ধারায় সেই সংস্থান রয়েছে। এই ধারার দু’টি ভাগ।
• ৭(১) ধারা অনুযায়ী, জনস্বার্থে শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে কেন্দ্র।
• ৭(২) ধারা অনুসারে, শীর্ষ ব্যাঙ্কের পর্ষদকে সরাসরিই নির্দেশ দিতে পারে সরকার।

এমনিতেই সিবিআইয়ের কাজে সরকারি হস্তক্ষেপ ও তার জেরে শীর্ষকর্তাদের মধ্যে সংঘাত নিয়ে মোদী সরকার প্রশ্নের মুখে। তার মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠানেও নাক গলানো নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’-এর দাবি করেছিলেন মোদী। বাস্তবে সরকার সমস্ত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কাজে নাক গলাচ্ছে। মোদী সরকারই উর্জিতকে গভর্নর করেছিল। তাঁর সঙ্গেও সরকারের মতের অমিল হচ্ছে।

কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের অনুমান, উর্জিত পদত্যাগ করবেন না। আগামী ১৯ নভেম্বর ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ডের বৈঠক ডেকেছেন তিনি। তা থেকেই স্পষ্ট, তার আগে পদত্যাগের সম্ভাবনা নেই। অর্থ মন্ত্রকের সূত্রের দাবি, সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতাকে সম্মান জানায় বলে বিবৃতি দিয়ে উর্জিতের মুখরক্ষার ব্যবস্থা করেছে। ফলে যত ক্ষণ না ৭ নম্বর ধারাকে কাজে লাগিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর পদত্যাগের কারণ নেই। তবে আগামী মাসে অর্থসচিবের পদ থেকে হাসমুখ আঢিয়া অবসর নেওয়ার পরে তাঁকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর করা হবে কি না, সেই জল্পনাও রয়েছে। আর এ দিনই উর্জিতকে নিশানা করেছেন আরএসএসের সঙ্গী সংগঠন স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের নেতা অশ্বিনী মহাজন।

মোদী সরকারকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্যের সমালোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর যদি তাঁর অফিসারদের শৃঙ্খলার মধ্যে না রাখতে পারেন, তা হলে তাঁর চলে যাওয়াই ভাল।’’

অনাদায়ী ঋণের বোঝায় দুর্বল সরকারি ব্যাঙ্কগুলির ঋণ বিলিতে রাশ টেনেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। নির্দেশ দিয়েছিল, শিল্প সংস্থাগুলি একদিনের জন্য ঋণ শোধে খেলাপ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। লোকসভা ভোটের আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কড়া মনোভাবে খুশি হতে পারেনি মোদী সরকার। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, নন-ব্যাঙ্কিং সমস্যা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বুঝতে পারছে না বলেই আবাসন, গাড়ি কেনায় ঋণের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফ্ল্যাট-গাড়ি বিক্রি কমছে। বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য বার্তা দিচ্ছিলেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। সূত্রের খবর, সেই আলোচনার মধ্যেই পাঠানো একাধিক চিঠিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আইনকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে তাদের কাজে নাক গলানোর চেষ্টা করে জেটলির মন্ত্রক।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ৭ নম্বর ধারায় জনস্বার্থের প্রয়োজনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে কোনও নির্দেশ দিতে পারে সরকার। তার আগে অবশ্য গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। আইনি ক্ষমতা থাকলেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে কোনও সরকারই এটি কাজে লাগায়নি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেন, ‘‘১৯৯১, ১৯৯৭, ২০০৮ বা ২০১৩-তে আমরা ওই ধারা কাজে লাগাইনি। এখন কী দরকার পড়ল? এ থেকেই স্পষ্ট, সরকার মরিয়া হয়ে অর্থনীতি সম্পর্কে তথ্য লুকোতে চাইছে।’’ তাঁর মতে, ১৯৯১, ১৯৯৭ বা ২০০৮— কখনও অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা বিশ্বজোড়া আর্থিক সঙ্কটের জেরে দেশের অর্থনীতি বিপদের মধ্যে পড়েছিল। ‘‘এখনও কি তা হলে অর্থনীতিতে জরুরি অবস্থা’’— প্রশ্ন তুলেছেন চিদম্বরম। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির জবাব, ‘‘বিশ্বের সর্বোচ্চ হারের আর্থিক বৃদ্ধির অর্থনীতিতে যদি কেউ জরুরি অবস্থা তৈরি হয়েছে বলেন, তা হলে তাঁর কিছুই জানা নেই।’’

আইনের ক্ষমতা কেন কাজে লাগানো হল? জেটলির জবাব, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা আমরা কখনওই প্রকাশ করি না। শুধু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়।’’

বাজপেয়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার মতে, সরকার যদি সত্যিই নাক গলায়, তা হলে গভর্নরের এখনই পদত্যাগ করা উচিত। বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর যুক্তি, উর্জিত পদত্যাগ করলে দায় জেটলিকেই নিতে হবে। কারণ, তিনি অনাদায়ী ঋণের সমস্যার জন্য গভর্নরের সমালোচনা করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE