Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কুবের উবাচ

নিজের লক্ষ্য জানা। সেই অনুসারে পরিকল্পনা করা। তার পরে লগ্নির দিকে এগোনো। সম্পদ গড়ার সাফল্যের মূলমন্ত্র এটাই। আর এর প্রতিটিই আমি দেখতে পেলাম সৌরভের প্রোফাইলে।

শৈবাল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

নিজের লক্ষ্য জানা। সেই অনুসারে পরিকল্পনা করা। তার পরে লগ্নির দিকে এগোনো। সম্পদ গড়ার সাফল্যের মূলমন্ত্র এটাই। আর এর প্রতিটিই আমি দেখতে পেলাম সৌরভের প্রোফাইলে। সত্যি কথা বলতে, ২৪ বছর বয়সে কারওর এত গোছানো পরিকল্পনা আমি এর আগে দেখেনি।

সবেমাত্র চাকরিতে পা দিয়েছেন। সংসারের কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড়গুণ হল, নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারার একাগ্রতা। অর্জুন যেমন শুধুমাত্র পাখির চোখই দেখেছিলেন, তেমনই সৌরভের লক্ষ্য হল পরিবারের মাথার ছাদ জোগানো। তাঁদের পারিবারিক জমি ও বাড়ি থাকলেও, শরিক অনেক। আগামী দিনে সেই জমি-বাড়ির কী হবে ঠিক নেই। ফলে এখন থেকেই নিজের ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছেন তিনি। যা একদম সঠিক সিদ্ধান্ত।

তিনি নিজের চিঠিতে অনেক প্রশ্নই করেছেন। তবে যেহেতু তাঁর প্রথম লক্ষ্যই হল ফ্ল্যাট, তাই এ নিয়েই আগে কথা বলব।

ফ্ল্যাটের ডাউনপেমেন্ট

২০১৮ সালের মধ্যে ফ্ল্যাট কিনতে চান সৌরভ। খুব বেশি দেরি হলে অপেক্ষা করতে পারবেন ২০২০ পর্যন্ত। ফ্ল্যাটের দাম ৩৬ লক্ষ টাকা ধরে, ডাউনপেমেন্টের জন্য ৭.২ লক্ষ (মোট দামের ২০%) জোগাড়ের কথা ভাবছেন। এ জন্য ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা করেছেন। মোটের উপর তাঁর পরিকল্পনা ঠিকই রয়েছে। তবে তারই কিছু জিনিস বদলে দেব।

বিমা পলিসি

আগামী দু’তিন বছরে তাঁর ও বাবা-মায়ের নামে থাকা এলআইসি-র বেশ কয়েকটির মেয়াদ শেষ হবে। জীবনবিমার নিগমের পলিসি আগামী দিনে কী রকম বোনাস দিতে পারে, তা আঁচ করে এই প্রকল্পগুলি থেকে হাতে ২ লক্ষ টাকা আসবে বলে তিনি ধরছেন। আমার মতে,

• এ ভাবে না-ভেবে বরং এখন যে- বোনাস সংস্থা দেয়, তার ভিত্তিতে হিসাব করুন। কোনও কারণে কম বোনাস ঘোষণা হলে রিটার্নের অঙ্কও কমবে। তখন নিরাশ হতে হবে।

• যে-পলিসিগুলির আর মাত্র দু’তিন বছর বাকি, সেগুলি চালিয়ে যান।

• ২০১৪ সালে শুরু করা পলিসিগুলির একটির ইতিমধ্যেই তিন বছর হয়ে গিয়েছে। বাকি দু’টি তৃতীয় বছরের প্রিমিয়াম দেওয়ার পরে সবগুলি পেড-আপ করুন। ২০১৫ সালে শুরু পলিসি-র ক্ষেত্রেও একই কথা ভাবুন।

রেকারিং

• দু’টি রেকারিং থেকে ২.৯৭ লক্ষ টাকা আসবে বলে ভেবেছেন তিনি। এগুলি চালিয়ে যান।

• পলিসি পেড-আপ করে দিলে, এ জন্য রাখা রেকারিং লাগবে না। ফলে সেই টাকা ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে রাখুন। এতে তুলনায় বেশি রিটার্ন পাবেন।

মিউচুয়াল ফান্ড ও শেয়ার

ফান্ড থেকে ২০১৮ সালে ২.৮২ লক্ষ বা ২০২০ সালে ৫.৩৪ লক্ষ টাকা আসবে বলে ধরেছেন সৌরভ। তা ঠিক নয়। কারণ স্বল্প মেয়াদে মিউচুয়াল ফান্ড ও শেয়ারের রিটার্ন নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই বলা যাবে না যে, শেয়ারে লগ্নি থেকে তিনি ১৫% রিটার্ন পাবেনই। দীর্ঘ মেয়াদে আমরা রিটার্ন ধরে হিসাব করি ঠিকই, কিন্তু সে জন্য লগ্নির সময় হতে হবে কমপক্ষে ২০-২৫ বছর। এ ক্ষেত্রে ততটা সময় দেওয়া সৌরভের পক্ষে সম্ভব নয়।

• যত টাকা তিনি শেয়ার বা ইকুইটি ফান্ডে (শেয়ার ভিত্তিক) রাখছেন, এক বছর হয়ে গেলেই তা তুলে লিকুইড বা ডেট ফান্ডে (ঋণপত্র নির্ভর) সরিয়ে নিন। প্রথমত, ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে ঝুঁকি তুলনায় কম। দ্বিতীয়ত, শেয়ার বা ফান্ডে এক বছর লগ্নি ধরে রাখতে পারলে টাকা করমুক্ত হয়ে যায়। ফলে তা সহজেই সরিয়ে নেওয়া যায়। তার উপর পলিসি পেড-আপের পরে হাতে আসা টাকাও ফান্ডে রাখলে, তহবিল মন্দ জমবে না। আপাতত এ ভাবে যতটা টাকা ওঠে, ততটা দিয়েই ডাউনপেমেন্ট করতে হবে। যদি মনে করেন, এই টাকার পুরোটা ফ্ল্যাটে লাগছে না, তা হলে ফান্ড চালিয়ে যেতে হবে। ধরে রাখতে হবে শেয়ারও।

হাতে নগদ

এখন সব খরচের পরেও সৌরভের হাতে প্রায় ১০ হাজার টাকা থাকে। তা দিয়ে নতুন এসআইপি চালু করুন। রেজিস্ট্রেশন, স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে এই টাকা লাগবে। পুরো টাকা প্রয়োজন না-হলে তা অবসরের জন্য রাখতে হবে।

জীবনবিমা

সৌরভকে পরিবারের সঞ্চয়ের পুরো দিকটাই দেখতে হয়। তাই ডাউনপেমেন্টের টাকা জোগাড়ের পাশাপাশি প্রথম কাজই হল নিজের জন্য টার্ম পলিসি কেনা। তাঁর নামে ৮.৮ লক্ষ টাকার বিমা পলিসি রয়েছে। সৌরভের কিছু হলে পরিবারের বাকি তিন জনের জন্য তা কখনওই যথেষ্ট নয়। বাবা-মায়ের নামে যে পলিসিগুলি রয়েছে, তারও বিমামূল্য বেশি নয়। ফলে সেগুলিও খুব একটা কাজে আসবে না। তাই প্রথমেই কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকার একটি টার্ম পলিসি কিনুন। মাথায় রাখবেন বিয়ের পরে সেই অঙ্ক আরও বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্যবিমা

সৌরভের চিকিৎসা বিমার অঙ্ক মাত্র ৩ লক্ষ টাকা। আর বাবা-মায়ের ২.৫ লক্ষ। তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। ফলে নিজের বিমার অঙ্ক বাড়ান। পাশাপাশি দেখুন, বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও তা বাড়ানো সম্ভব কি না।

অবসরের তহবিল

ফ্ল্যাট কেনার পরে মন দিতে হবে অবসরের তহবিল তৈরিতে। এ জন্য—

শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড

এই দুই খাতে যে-টাকা তিনি রাখছেন, ফ্ল্যাট কেনার পরেও দীর্ঘ মেয়াদে সেই লগ্নি চালাতে হবে।

পিপিএফ

সৌরভের একটি পিপিএফ রয়েছে। আরও একটি পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খোলার কথা ভাবছেন। নিয়ম অনুসারে এক ব্যক্তি নিজের নামে দু’টি পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না। ফলে ওই দুই অ্যাকাউন্ট থেকে অবসরের তহবিল তৈরির যে-পরিকল্পনা তিনি করেছেন, তা কাজে লাগবে না। সে ক্ষেত্রে তাঁকে বরং এসআইপি বা শেয়ার ও অন্যান্য প্রকল্পে লগ্নি করতে হবে। বরং তাঁর বর্তমান পিপিএফটি মেয়াদ শেষের পরে পাঁচ বছর করে বাড়াতে পারেন।

পিএফ/ ভিপিএফ

পিএফের তহবিল রাখতে হবে অবসর জীবনের জন্য। এর সঙ্গেই ভিপিএফের মাধ্যমে মাসে ১,০০০ টাকা করে তিনি রাখছেন, তা বিয়ের সময়ে লাগবে। এ ছা়ড়া খুব একটা উপায়ও নেই। তবে বিয়ের পরে সেই টাকা ফের লগ্নি করতে হবে অবসরের জন্য।

• হাতে থোক টাকা এলে, তা এনএসসি-র মতো প্রকল্পে রাখার কথা ভেবে দেখতে পারেন।

• আগামী দিনে উচ্চশিক্ষা শেষ করতে চান সৌরভ। বেতন বাড়াতে যা সাহায্য করবে। মাইনে বাড়লে সেই টাকাও বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়মিত লগ্নি করে যেতে হবে।

আগাম লেনদেন

সবে শেয়ার বাজারে পা রেখেছেন সৌরভ। লগ্নিও বেশি নয়। তাই এখনই আগাম লেনদেনের (ফিউচার অ্যান্ড অপশন) দিকে ঝোঁকা উচিত নয় বলে আমার মত। ইতিমধ্যেই তিনি এই দুই ধরনের লেনদেন নিয়ে পড়াশোনা করছেন, যা তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। কিন্তু তা-ও আমি বলব কিছু দিন অপেক্ষা করুন। কারণ এই ধরনের লেনদেনে ঝুঁকি অনেকটাই বেশি। বেশি লাভের সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনই হঠাৎ করে সব লগ্নি হারানোর ভয়ও রয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো না-করে বরং, বিষয়টি জানুন। তার পরে সিদ্ধান্ত নিন।

তত দিন আমি তাঁকে মিউচুয়াল ফান্ড ও সরাসরি শেয়ারে লগ্নির পরামর্শ দেব। যে ১০,০০০ টাকা তিনি প্রতি মাসে শেয়ারে খাটানোর পরিকল্পনা করেছেন, তা এই দুই খাতে ভাগ করে রাখতে পারেন। তবে তা করতে হবে ধৈর্য ধরে, দীর্ঘ মেয়াদে। চটজলদি লাভের আশা না-করলেই ভাল করবেন। বুঝতে পারছি ফ্ল্যাটের ডাউনপেমেন্টের জন্য টাকা জোগাড় করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে বেশি ঝুঁকি নিয়ে যদি পুরো লগ্নিই হারাতে হয়, তা হলে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয়, হাতের লক্ষ্মীও জলে যাবে।

গাড়ি বা বেড়ানোর পরিকল্পনা স্থগিত থাকুক। প্রথম লক্ষ্যপূরণ হলে, তার পর এ নিয়ে ভাবা যাবে।

সৌরভের মতো পরিকল্পনা করতে খুব কম মানুষকে দেখেছি। যা তাঁকে অন্যের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে রাখছে। আশা করব আগামী দিনেও এ ভাবেই তিনি লগ্নি গুছিয়ে নিতে পারবেন।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত

(ছবি প্রতীকী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

savings plan financial expert
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE