Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সুদের বাদ্যি বাজছে, তাল মেলাবেন কী ভাবে?

পুজোর ঢাকে কাঠি পড়তে এখনও ক’দিন বাকি। কিন্তু সুদের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। বিভিন্ন স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প এবং ব্যাঙ্ক আমানতে যেমন তা বাড়ছে, তেমনই ঋণে তা বৃদ্ধির জেরে মাথাব্যথা মাসিক কিস্তি নিয়েও। তাল খুঁজলেন অমিতাভ গুহ সরকারসুদের বাড়া-কমা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কিন্তু সেই গুরুত্ব বোধহয় শুধু ব্যাঙ্ক-জমা কিংবা স্বল্প সঞ্চয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে ঋণপত্র (বন্ড), শেয়ার বাজার ইত্যাদির উপরেও। কী ভাবে? আজকের আলোচনা তা নিয়েই। শুরু করা যাক গোড়ার কথা দিয়ে।

পুজোর মুখে খুশির খবর। স্বল্প সঞ্চয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে সুদ বেড়েছে ৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত।

পুজোর মুখে খুশির খবর। স্বল্প সঞ্চয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে সুদ বেড়েছে ৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত।

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:২০
Share: Save:

পুজোর মুখে খুশির খবর। স্বল্প সঞ্চয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে সুদ বেড়েছে ৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত। এক লাফে অনেকটাই বলা চলে। তার সঙ্গে আবার ব্যাঙ্কগুলিও আমানতে সুদ বাড়াতে শুরু করেছে। ফলে যাঁদের আয় সুদ নির্ভর, তাঁরা মোটের উপর খুশি। কিন্তু সুদ তো শুধু সঞ্চয়ে বাড়ছে না। তা মাথা তুলছে ঋণেও। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ব্যাঙ্ক সেই পথে হেঁটেছে। ফলে যাঁদের বাড়ি, গাড়ি ঋণের মাসিক কিস্তি দিতে হয়, তাদের চিন্তাও বাড়ছে তাল মিলিয়ে।

সুদের বাড়া-কমা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কিন্তু সেই গুরুত্ব বোধহয় শুধু ব্যাঙ্ক-জমা কিংবা স্বল্প সঞ্চয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে ঋণপত্র (বন্ড), শেয়ার বাজার ইত্যাদির উপরেও। কী ভাবে? আজকের আলোচনা তা নিয়েই। শুরু করা যাক গোড়ার কথা দিয়ে।

সুদ কেন বাড়ে বা কমে?

দেশে সুদের হার নিয়ন্ত্রণের সুতো মূলত থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে। মৃল্যবৃদ্ধির হার মাথাচাড়া দিলে, তারা তা বাড়ায়। ওই হার কমলে, উল্টোটা। কোনও কারণে বাজারে পণ্যের জোগান কমে গেলে, চাহিদা হঠাৎ খুব বাড়লে কিংবা বাজারে টাকার জোগান বৃদ্ধি পেলে সুদ বৃদ্ধির অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রে রেপো রেট বাড়ায় তারা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুদ বাড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও। সুদ বাড়লে ঋণের চাহিদা কমে এবং মানুষ আরও বেশি করে টাকা সঞ্চয় করেন। সে ক্ষেত্রে বাজারে টাকার জোগান কমে। ফলে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসে মূল্যবৃদ্ধি।

একই ভাবে, জিনিসপত্রের দাম দ্রুত কমতে থাকলে সুদ কমায় শীর্ষ ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও সাধারণত সুদ কমায়। ফলে লাভ হয় যাঁরা ঋণ নেন তাঁদের। কিন্তু চিন্তা বাড়ে সুদ নির্ভর মানুষদের।

লগ্নির আগে জানুন

আমরা বেশি রিটার্ন পেতে শেয়ার বাজার, ফান্ড বা বন্ডের মতো প্রকল্পের কথা বলি। কিন্তু তেমনই সঞ্চয়ে ঝুঁকি ছেঁটে ফেলতে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের সুদ নির্ভর প্রকল্পগুলিতেও আমাদের আস্থা যথেষ্ট। বহু মানুষ, বিশেষত প্রবীণরা মূলত এই সমস্ত প্রকল্পের উপর নির্ভর করেই সংসার চালান। যাঁরা ঝুঁকি নিতে একেবারেই চান না, তাঁদেরও গন্তব্য এগুলি। তাই লগ্নির জগতে সুদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কোন কোন বিষয়ে তার প্রভাব পড়ে, তা আগে থেকে জেনে রাখা জরুরি।

বন্ডের যোগ

বন্ডের সঙ্গে সুদের ‘শত্রুতা’ বরাবরের। সুদ যে দিকে হাঁটে, বন্ডের বাজারদর হাঁটে তার বিপরীত দিকে। অর্থাৎ সুদ কমলে বন্ডের বাজারদর বাড়ে। আর সুদ বাড়লে হয় উল্টোটা। কারণ—

• ধরুন, একটি বন্ড ইস্যু হয়েছে। তার বাজার দর ১০০ টাকা। আর সুদ (কুপন রেট) ছিল ৮%। তখন ব্যাঙ্কের সুদও ছিল একই।

এ বার, ব্যাঙ্কে সুদ কমে হল ৭%। কিন্তু বন্ডে তখনও সুদ মিলবে ৮% হারে। তাই তার চাহিদা বাড়বে। ফলে আরও বেশি মানুষ তাতে আগ্রহ দেখানোয়, বাজারে সেই পুরনো বন্ডের দামও বেড়ে যাবে। ফলে কমে আসবে তার প্রকৃত রিটার্ন (ইল্ড)। কারণ, তখন বেশি টাকা দিয়ে বন্ড কিনে তবে পুরনো কূপন রেট পেতে হচ্ছে।

• আবার মনে করুন, ব্যাঙ্কে সুদের হার এবং বন্ডের কুপন রেট দুই-ই ছিল ৭%। এ বার ব্যাঙ্কে সুদ যদি বেড়ে ৮% হয়, তা হলে সেখানে টাকা রাখায় আগ্রহ বাড়বে। অনেকেই বন্ড বেচে লগ্নি সরিয়ে আনবেন ব্যাঙ্কে। কমবে বন্ডের চাহিদা। তার দামও নেমে আসবে। ওই সময়ে যদি সেই বন্ডে ৮% ইল্ড পেতে হয়, তা হলে বন্ডের বাজারদর কমে হতে হবে ৮৭.৫ টাকা। অনেক সময়ই কিন্তু এ ধরনের ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।

সুদ আর ডেট ফান্ড

ব্যাঙ্কে সুদ যখন বাড়ছে, তখন ঋণপত্র নির্ভর (ডেট) ফান্ডে টাকা ঢেলে নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই। কারণ—

ধরা যাক আপনার ফান্ড ১০% সুদে ১০০ টাকার (ফেস ভ্যালু) একটি বন্ড কিনেছে। পরে সুদ বেড়ে হল ১২%। অর্থাৎ, এ বার ১০০ টাকার কম ঢেলেই বছর শেষে ১১০ টাকা পাওয়া যাবে। তা হলে ওই বন্ড কেউ ১০০ টাকায় কিনবেন কেন? তাই স্বাভাবিক ভাবেই দর পড়ে যাবে তার। এখন যেহেতু বাজারে সুদ বাড়তির দিকে, সেহেতু বন্ডের দাম কমছে। আর বন্ডের দাম কমায় তার উপর নির্ভরশীল ফান্ডের তহবিলে প্রভাব পড়ছে। কিছুটা মার খাচ্ছে রিটার্ন।

নজর শেয়ার বাজারেও

শেয়ার বাজারের সঙ্গেও কিন্তু সুদের সম্পর্ক রয়েছে। কেন? দেখে নিই—

• সাধারণ মানুষ বাড়ি, গাড়ি কেনা অথবা নিজের ব্যবসা চালুর জন্য ঋণ নেন। তেমনই বিভিন্ন ব্যবসা চালাতে সংস্থা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নেয়। যার অঙ্ক বিশাল। ফলে যদি সুদ বেড়ে যায়, তা হলে সংস্থাগুলির খরচ বাড়ে। কমে মুনাফা। ফলে তাদের শেয়ার দর পড়ে। আর তার প্রভাবে অনেক সময়ে পতন হয় শেয়ার বাজারেরও।

• এই কারণেই সুদ বাড়লে সংস্থাগুলি লগ্নি বাড়াতে চায় না। তাতে বেশি টাকা ধার করতে হয় তাদের।

• সুদ বাবদ খরচ বাড়লে, কিছু ক্ষেত্রে তা মেটানোর সামর্থ্য থাকে না অনেক সংস্থার। ফলে বাড়ে ঋণখেলাপি। তার প্রভাবও পড়ে শেয়ার বাজারে।

এখন কী অবস্থা?

সুদ বাড়ছে বলে এই মুহূর্তে নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। কারণ—

• টাকার সাপেক্ষে ডলারের দাম সর্বকালীন উচ্চতায়। বুধবারই তা ছাড়িয়েছে ৭৩ টাকার গণ্ডি।

• আমেরিকা ও চিন একে অপরের পণ্যে শুল্ক বসিয়েই চলেছে। যার জেরে চোখ রাঙাচ্ছে বাণিজ্য যুদ্ধ।

• বিশ্ব বাজারে বাড়ছে অশোধিত তেলের দাম। ফলে দেশে পেট্রল, ডিজেলের দরও ঊর্ধ্বমুখী।

• এই সব কারণে শেয়ার বাজার টালমাটাল। প্রায় রোজই পড়ছে সূচক (বুধবারেও সেনসেক্স নেমেছে ৫৫০ পয়েন্ট, নিফ্‌টি ১৫০ অঙ্ক)। তাই লগ্নি ছড়াতে হবে বুঝেশুনে।

আপনার করণীয়

সুদের প্রভাব কোথায়, কী ভাবে পড়ে তা নিয়ে এত ক্ষণ কথা বললাম। এ বার চলুন দেখে নিই এই অবস্থায় আপনি কী করবেন?

সুরক্ষাই লক্ষ্য

আপনি বেশি ঝুঁকি নিতে চান না। সে জন্য কিছুটা কম রিটার্নও মেনে নিতে রাজি। তা হলে সুদ যখন বাড়ছে, তখনই ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের প্রকল্পে টাকা রাখা আপনার পক্ষে ভাল। কারণ এর কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন—

• সুদের হার নির্দিষ্ট করে বলা থাকে। তাই মেয়াদ শেষে হাতে কত টাকা আসবে তা আগে থেকে জানা যায়।

• এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় সুবিধা হয়।

• এমনিতেই ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে মানুষের আস্থা রয়েছে। তার উপরে স্থায়ী আমানত, পিপিএফ, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের (এনএসসি) মতো প্রকল্পে সুরক্ষা তুলনায় বেশি।

• বর্তমানে সকলের দরজায় আর্থিক পরিষেবা পৌঁছনোর উদ্যোগী হয়েছে ব্যাঙ্ক, ডাকঘর। বিশেষত পোস্ট অফিস পেমেন্টস ব্যাঙ্কও চালু হয়েছে। ফলে আধা শহর বা গ্রামাঞ্চলে তার শাখা খুঁজে পাওয়া তুলনায় সহজ।

লগ্নি যখন শেয়ারে

শেয়ারে টাকা খাটিয়ে থাকলে—

• যাদের বাজারে ধার বেশি, সেই সব সংস্থায় লগ্নি কমিয়ে আনুন।

• তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর সুদ বৃদ্ধির তেমন প্রভাব নেই। বরং ডলারের দাম বাড়ায় এই সমস্ত সংস্থা ও ওষুধ সংস্থার শেয়ার দর এখন বেশ ভাল বাড়ছে। তাই নজর রাখুন সেগুলির উপরে।

• ঝুঁকি কমাতে চাইলে চড়া সুদের জমানায় হাতে থাকা শেয়ার বেচে তহবিলের কিছুটা তুলনায় সুরক্ষিত প্রকল্পে রাখার কথা ভাবুন।

বন্ড ও ফান্ড

• সুদ বাড়ায় বন্ড ফান্ডের ন্যাভ কিছুটা কমেছে। এখন থেকে সুদের হারের উপর নজর রেখে এই ধরনের ফান্ডে নতুন লগ্নির কথা ভাবা যেতে পারে।

• দেখুন পুরনো ডেট ফান্ডের রিটার্নে কতটা প্রভাব পড়ছে। সেই অনুসারে লগ্নি সরাতে পারেন স্বল্প সঞ্চয় বা ব্যাঙ্ক আমানতে। যাতে ঝুঁকি কিছু কমে।

• যাঁরা উঁচু হারে কর দেন, তাঁরা ফান্ডের তিন বছর বা তার বেশি মেয়াদের ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যানে লগ্নির কথা ভাবতে পারেন। সুরক্ষার দিকটা অবশ্য দেখে নিতে হবে।

• নতুন বন্ডের সুদ পৌঁছেছে ৯ শতাংশে। লগ্নি করা যায় সুরক্ষার দিক দেখে নিয়ে। একই বন্ডে মোটা টাকা লগ্নি করা ঠিক হবে না।

স্বস্তি প্রবীণদের

সুদ বাড়লে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পান প্রবীণরা। বছর তিনেক আগে থেকে সুদ কমতে থাকায়, তাঁদের এক রকম নাভিশ্বাস উঠেছিল। বিশেষ করে যাঁরা বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন এবং যাঁদের পুঁজি বেশ ছোট।

অনেক প্রকল্পে প্রবীণরা সুদ পান ২৫-৫০ বেসিস পয়েন্ট বেশি। এই বাড়তি সুদ ধরলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাপ্তি দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশ। তাই সব মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য পরিস্থিতি আগের থেকে ভাল।

অতএব

নিজের লগ্নির পোর্টফোলিও দেখুন। যে-সব প্রকল্পে তুলনায় কম রিটার্ন পাচ্ছেন, তা থেকে বেরিয়ে এসে বেশি আয়ের প্রকল্পে লগ্নির কথা ভাবতে পারেন। তার উপরে আগামীকাল ঋণনীতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলে ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে ফের এক দফা সুদের হার বাড়তে পারে। আগামী দিনে বাড়তি সুদের সুবিধা নিন।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investment Tips Investment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE