দেশে-বিদেশে উত্তরবঙ্গের চায়ের কদর আরও বাড়াতে কীটনাশকের ব্যবহার খতিয়ে দেখে স্থানীয় স্তরেই তার গুণগত মান পরীক্ষার ব্যবস্থা অবশেষে তৈরি হচ্ছে টি বোর্ডের হাত ধরে।
নিউ জলপাইগুড়ির ‘টি পার্ক’-এ ৭ কোটি টাকা খরচে তৈরি আধুনিক পরীক্ষাগার চালু করছে টি বোর্ড, যা বিশেষ করে ছোট চাষিদের মধ্যে কীটনাশকের ব্যবহারবিধি নিয়ে সচেতনতা বাড়াবে বলে মনে করছে চা শিল্পমহল। কারণ, এত দিন উত্তরবঙ্গে চায়ের মান পরীক্ষার জন্য কোনও পরীক্ষাগারই না-থাকায় চায়ের গুণগত মান খতিয়ে দেখার সুযোগও ছিল সীমিত। অথচ চা পাতায় কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি পরিমাণে থাকায় বাজার হারানোর আশঙ্কাও বাড়ছিল। চা শিল্পের দাবি, শুধু রফতানি নয়, দেশীয় বাজারেও চায়ের গুণমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে এই পরীক্ষাগার।
আজ, রবিবার তিন দিনের সফরে উত্তরবঙ্গে আসছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আগামী মঙ্গলবার ওই পরীক্ষাগারটি উদ্বোধন করার কথা তাঁর। চা পরীক্ষার জন্য এখন কলকাতা ও অসমের টকলাইতে টি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের দুটি কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গে এত দিন তা ছিল না। টি বোর্ডের সূত্রের খবর, নাগরাকাটার পরীক্ষাগারটিতে চায়ের কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ফলে দূরে চা পাঠাতে যেমন সময় বেশি লাগত, তেমনই খরচও বেশি পড়ত। আখেরে ভুগতে হত চা শিল্পকেই, বাড়ছিল রফতানির বাজার হারানোর সম্ভাবনাও।
প্রসঙ্গত, চা গাছে কীটনাশক ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকলেও চাষিদের একাংশ তা কতটা মেনে চলেন তা নিয়ে অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। ছোট চাষিদের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় সেই আশঙ্কা আরও বেড়েছে বলেই দাবি সংশ্লিষ্ট শিল্পের। এখন দেশের চা উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসে ক্ষুদ্র চা চাষিদের কাছ থেকে। অনেক বড় বাগানও তাঁদের কাছ থেকে চা পাতা কেনে। উপরন্তু চা শিল্প সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে ডুয়ার্স-তরাইয়ের বাগানের চা গাছের গড় আয়ু বেশি হওয়ায় সেগুলির উৎপাদনশীলতাও কম। সব মিলিয়ে চায়ের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অনেক ক্ষেত্রেই কীটনাশক ব্যবহারে বাড়বৃদ্ধি ঘটে।
ইতিমধ্যে রফতানি বাজারে বিভিন্ন দেশ চায়ের মান নিয়ে কড়াকড়ি শুরু করায় কিছুটা সমস্যায় পড়েছে চা শিল্পের একাংশ। সরকারি ভাবে কেউ মানতে না-চাইলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের ইঙ্গিত, গুণমানের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় কিছু দেশ ভারতীয় চা ফেরত পাঠিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কীটনাশকের ব্যবহারবিধি নির্দিষ্ট করতে ‘প্লান্ট প্রোটেকশন কোড’ চালু হয়েছে।
চা শিল্পের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন আগেই পরীক্ষাগারটি গড়ার কথা ঘোষিত হলেও তা চালু করতে সময় লাগল। সরকারি সূত্রের খবর, সেখানে চায়ে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করা যাবে। এখন ৮-১০টি কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা করা যাবে। পাশাপাশি চায়ে ভারী ধাতুর উপস্থিতি এবং ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক ইত্যাদি রয়েছে কি না, তা-ও জানা যাবে। তেমনই স্বাস্থ্যহানি রুখতে যে-কোনও খাবারের গুণমানের বিভিন্ন মাপকাঠি স্থির করে দেয় ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এফএসএসআই)। তাদের বেঁধে দেওয়া ৬-৭টি মাপকাঠি চায়ে ঠিক রয়েছে কি না সেটি জানা যাবে। ভবিষ্যতে সব ধরনের পরীক্ষার বহরও বাড়বে বলে দাবি টি বোর্ডের। এখন প্রক্রিয়া করা চায়ের গুণমান পরীক্ষা করা হলেও আগামী দিনে চা পাতাও পরীক্ষার সুযোগ মিলবে। কেন্দ্রটির ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন বা এনএবিএল স্বীকৃতির জন্যও আবেদন করেছে টি বোর্ড।
ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান আজম মোনেম, সেক্রেটারি জেনারেল অরিজিৎ রাহা, ছোট চা চাষিদের সংগঠন ‘সিস্টা’র প্রেসিডেন্ট বিজয়গোপাল চক্রবর্তী, সকলেই এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন। মোনেম বলেন, ‘‘অনেক আগেই ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত এটি চালু হওয়ায় সুবিধা হল। ক্ষুদ্র চাষ বাড়ায় চা পাতা পরীক্ষারও প্রয়োজন হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, পরীক্ষায় ত্রুটি দেখা দিলে দ্রুত সংশোধন করার সুযোগ বাড়বে, যা ভবিষ্যতে রফতানির সুযোগ আরও বাড়িয়ে দেবে।
কীটনাশকের ব্যবহারবিধি নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও ছোট চা চাষিদের মধ্যে বিষয়টি যে এখনও সে ভাবে ছড়ায়নি, তা মানছেন বিজয়গোপালবাবু। তাঁর মতে, কাছেপিঠে এ ধরনের পরীক্ষাগার চালু হলে তা সঠিক কীটনাশকের ব্যবহার ও চা চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy