Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘রাজা’র বাড়ির বকেয়া কর ১৩ লক্ষ!

বহুদিন হল ওই বাড়ির মালিকানা মল্লিক পরিবারের হাতে নেই। সত্তরের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ পুরসভার সম্পত্তিকরের বিলে বাড়ির মালিক হিসেবে লেখা এইচ সি মল্লিকের নাম।

জরাজীর্ণ: সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সেই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

জরাজীর্ণ: সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সেই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ০২:০৪
Share: Save:

বাইরে হলুদ ফলকে লেখা রাজার বাড়ি। লোহার গেট সামান্য ঠেলে ঢুকতেই নজর কাড়ে পুরনো ফটকের কাঠামো, কারুকার্য করা লোহার জাফরির জানলা। সবেতেই ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট। কলকাতা পুরসভা জানাচ্ছে, এই রাজার বাড়ির বকেয়া সম্পত্তিকর প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা! কর না মেটানোর জরিমানাই হল ৫৫ হাজার টাকা। বকেয়া সম্পত্তিকরের বিলে ঠিকানা ১২, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। মালিক ছিলেন রাজা সুবোধ মল্লিক।

যদিও সুবোধ মল্লিকের বংশধরেরা জানাচ্ছেন, বহুদিন হল ওই বাড়ির মালিকানা মল্লিক পরিবারের হাতে নেই। সত্তরের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ পুরসভার সম্পত্তিকরের বিলে বাড়ির মালিক হিসেবে লেখা এইচ সি মল্লিকের নাম। সুবোধ মল্লিক-পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরি কুণাল বসুমল্লিক বলেন, ‘‘এইচ সি মল্লিক হলেন হামিদচন্দ্র বসুমল্লিক। আমাদের জেঠামশাই। ওঁর মৃত্যুর পরে ওই সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে যায়। সম্পত্তিকরের ব্যাপারটা তো আমরা জানিই না! আমাদের জানার কথাও নয়। বকেয়া থাকলেও তা তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই মেটানোর কথা।’’ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর নিয়েছেন কুণালবাবু। তিনি জানান, এক সময়ে ১২, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের ওই বাড়িতেই তাঁর শৈশব কেটেছিল। এখনও ওই বাড়ির বন্ধ ঘরে তাঁর ছোটবেলার ফোটো দেখা যাবে।

যদিও তা দেখার উপায় নেই! কারণ, জীর্ণ বাড়ির একতলা বাদ দিয়ে সবটাই যাতায়াতের অগম্য। বিশাল বাড়ির দেওয়ালটা ডালপালা আর শিকড় প্রায় গ্রাস করেছে। নেমে এসেছে বটের ঝুড়ি। লাল ইটের কাঠামোর উপরে বিশালাকৃতি বাড়িটা যে এখনও দাঁড়িয়ে, তা-ই এক বিস্ময়!

এমন পরিস্থিতিতেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন কর্মী বহু বছর ধরে ওখানে থাকছেন। অথচ ভঙ্গুর ওই বাড়ি যে থাকার অনুপযুক্ত, তা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু উপায় নেই, কারণ তাঁদের কারও বাড়ি অন্য জেলায়, কারও আবার ভিন্‌রাজ্যে। প্রত্যেকেই অন্যত্র কোয়ার্টার্সের জন্য আবেদনও করে রেখেছেন।

এমনই এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘১২-১৩ বছর ধরেই এখানে আছি। আগে আরও অনেকে থাকতেন। বাড়ির অবস্থা দেখে তাঁরা অন্যত্র চলে গিয়েছেন।’’ আর এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘বাড়ির উপরের তলায় কাউকে উঠতে দিই না! যদি কারও কিছু হয়ে যায়, তখন তো আমাদের উপরেই দায়িত্ব আসবে।’’ যদিও ওই বিপজ্জনক বাড়িতে তাঁরা কেন থাকছেন, তার কোনও সদুত্তর নেই। এক জন শুধু বললেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় যা ঠিক করবে, সেটাই তো মানব।’’

এমনিতে এই বাড়ি নিয়ে আইনি জটিলতা বহু দিনের। বকেয়া সম্পত্তিকর-সহ বাড়িটির অন্য জটিলতা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘পরে ফোন করুন। বিষয়টি জেনে কথা বলব।’’ শুক্রবার তাঁকে ফের ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এখনও বিষয়টি জানা হয়নি। আইনি উপদেষ্টার থেকে বিস্তারিত জেনে কথা বলতে পারব।’’ পরে অবশ্য তিনি আর কিছু জানাননি।

এক সময়ে নষ্ট হতে বসা বাড়িটি বসুমল্লিক পরিবারের তরফে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে অধিগ্রহণের জন্য বলা হয়েছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও বাড়ির সংস্কারে উদ্যোগী হয়নি সরকার, বলছে বসুমল্লিক পরিবার।

ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দানা বেঁধেছিল এই বাড়ি থেকে। যার সর্বাগ্রে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। বাড়ির বাইরেই ফলকে লেখা রয়েছে, কলকাতায় থাকাকালীন অরবিন্দ এই বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বালগঙ্গাধর তিলক, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সে সময়ের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের যাতায়াত ছিল এই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ তো জাতীয় সঙ্গীতও গেয়েছিলেন এখানে।

ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির বাড়িটির ভিতরে ছিল বাগান, ফোয়ারা। বিদেশি সংস্কৃতি প্রভাবিত স্থাপত্যরীতি মেনেই বাড়িটি তৈরি। বসুমল্লিক পরিবারের তথ্য জানাচ্ছে, এক সময়ে বাড়ির অন্দরসজ্জায় ইউরোপের চিত্রকলার ব্যবহার হত। নাচের জন্য আলাদা জায়গা, লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর ছিল। আর ছিল ‘খিড়কি দরজা’। পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী, নববিবাহিতা বধূ ওই ‘খিড়কি দরজা’ দিয়েই বাড়িতে ঢুকতেন।

ইতিহাসের তথ্য উল্লেখ করে কুণালবাবু জানাচ্ছেন, সুবোধচন্দ্র কোনও রাজপরিবারে জন্মাননি, রাজা উপাধিও পাননি। ১৯০৫ সালের ৯ নভেম্বর যখন বাংলায় ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ তৈরি নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন ভিত্তি প্রস্তরের জন্য। সে দিন থেকেই লোকমুখে তিনি পরিচিত ‘রাজা’ সুবোধ মল্লিক নামে।

ওই বাড়িরই এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘থাকতে ভয় করে ঠিকই। কিন্তু রাজার বাড়ি তো! সবাইকে বলতে পারি, রাজার বাড়িতে থাকি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE