Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গাছ হয়ে ওঠার রূপকথা শুনল কলকাতা

সেই মুখচোরা কিশোর নরেন হাঁসদা আজ গাছ হয়ে উঠেছেন। ডালপালা মেলে শতাধিক ছেলেমেয়েকে সন্তানস্নেহে আগলে রাখেন তিনি। পুরুলিয়ার ভালডুংরির ‘সিধু কানু মিশন’-এর রূপকার তথা ঝুমুর-শিল্পী নরেন হাঁসদার সঙ্গে শনিবার কলকাতার দেখা হয়ে গেল।

জয়ের হাসি: পুরস্কার হাতে জুলেখা খাতুন। শনিবার ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ স্কুল পুরস্কার-এর মঞ্চে। —নিজস্ব চিত্র।

জয়ের হাসি: পুরস্কার হাতে জুলেখা খাতুন। শনিবার ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ স্কুল পুরস্কার-এর মঞ্চে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০২:১৪
Share: Save:

সাঁওতালি ছাড়া ক্লাসে বাংলা বুঝতে রীতিমতো হিমশিম খেত ছেলেটি। তাই ক্লাস এইট-এ স্কুল থেকে ছিটকে যায় সে। যেমনটা আকছার ঘটে থাকে পুরুলিয়ার অজ পাড়াগাঁয়ে।

সেই মুখচোরা কিশোর নরেন হাঁসদা আজ গাছ হয়ে উঠেছেন। ডালপালা মেলে শতাধিক ছেলেমেয়েকে সন্তানস্নেহে আগলে রাখেন তিনি। পুরুলিয়ার ভালডুংরির ‘সিধু কানু মিশন’-এর রূপকার তথা ঝুমুর-শিল্পী নরেন হাঁসদার সঙ্গে শনিবার কলকাতার দেখা হয়ে গেল।

আরও পড়ুন: আউটডোর বন্ধ, দিনভর ভোগান্তি

পুরুলিয়ায় নরেনের স্কুলে এখন সাঁওতালি ভাষাতেই পড়াশোনা শেখে কচিকাঁচারা। ঝুমুর গান, লোকনৃত্য থেকে সরহুল, বাঁদনা, করমের পরব-উদ্‌যাপনে পাঠ নেয় নিজেদের কোণঠাসা সংস্কৃতির। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ স্কুল পুরস্কার-এর আসরে নরেনের স্কুলের ছেলেমেয়ে, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা নাচের তালে মাতিয়ে গেলেন।

সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমার জলেজঙ্গলে ঘেরা মেহেরপুর তুলসীরানি স্মৃতি বিদ্যাপীঠ বা বোলপুরের কাছের লড়াকু ফুটবলার কন্যেদের ইস্কুল শ্রীজা স্পোর্টস অ্যাকাডেমিও অবশ্য কম যায় না! স্কুলের চৌকাঠ না-মাড়িয়ে বড় হয়ে ছেলেদের কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়াই এখনও দস্তুর বহু প্রত্যন্ত এলাকায়। আর মেয়ে হলে অকাল বিয়েটাই নিয়তি। সেখানে নিজেদের জীবন নিয়ে অন্য রকম গল্প লিখছেন, সুন্দরবন বা বীরভূমের অখ্যাত স্কুলের কিছু ছেলেমেয়ে। সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে সেই সব স্কুলকেও এ দিন সম্মানিত করা হল।

গজলডোবার গ্রাম্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতার ফিউচার হোপ স্কুলের রাগবি টিম ‘জাঙ্গল ক্রো’-এর উড়ানও তো জলজ্যান্ত রূপকথা! দেশের জুনিয়ার রাগবি ন্যাশনালে তাঁরা জয়মুকুট আদায় করে ছেড়েছেন। উষর জমিতেও গাছ হয়ে ওঠার জেদটা ছাড়তে নারাজ এই লড়াইগুলোই অনুষ্ঠানের মূল সুরটা বেঁধে দিল।

সঞ্চালক ব্যারি ও’ ব্রায়েন এই গাছেদের জল-সার দেওয়ার কথাই বলছিলেন। ২২ বছর আগে ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল ফাউন্ডেশন’-এর পথ চলা শুরু হয়েছিল। তখনও একটি চারা গাছই তো পোঁতা হয়েছিল। ব্যারি বার বার বললেন, এই চারা রোপণের সাহসটুকু শুধু বেঁচে থাকুক, সার-জল দিয়ে ভালবেসে বড় করার বন্ধু ঠিক জুটে যাবে!

অনুষ্ঠান জুড়ে তাই ছোট ছোট সব গাছেদের মাথা তোলার গল্প। বেশ কয়েক জন হবু গাছের সঙ্গেও দেখা হল। যেমন, জুলেখা খাতুন। মা-বাপের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রুখে দিয়ে বহরমপুরের হোমে থেকে মাধ্যমিক দিয়ে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেছেন। মাধ্যমিকের ১৭ দিন আগে অ্যাসিড হানার শিকার দক্ষিণ ২৪ পরগনার উস্তির গোলাপি খাতুনও পরীক্ষা বা জীবনে অপরাজিতা। লিউকোমিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা রানাঘাটের রাজেশ্বরী চক্রবর্তীও মাধ্যমিকে নজর কেড়েছেন। আখের রস বেচে গুরুচরণ কর্মকার মাধ্যমিকে ৯১ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন। মালদহের মুচির ছেলে ছোটন রবিদাসও ৮০ শতাংশ পেয়েছেন মাধ্যমিকে।

আগামীর গাছেদের বাঁচাতে বার বার গ্রামে যাওয়ার কথা বলা হল শহুরে পড়ুয়াদের। গাছ-জলাভূমিকে আঁকড়ে বাঁচার ডাক উঠল। লড়তে নেমেও গাছ হয়ে ওঠা যাদের হল না, তাদের ভাগেও কম আদর জোটেনি। অকালে মুছে যাওয়া চারাদের মা-বাবারাও বরাবরই এ আসরের মূল চরিত্র। বসিরহাটে বাইক দুর্ঘটনার শিকার স্বর্ণেন্দু রায়ের মা-বাবা সুজাতা ও চন্দ্রশেখর কিছু পুরস্কার দিলেন। একমাত্র সন্তানকে হারিয়েও সঙ্গে সঙ্গে তার লিভার, কিডনি, চোখ দান করেছিলেন এই দম্পতি। পেশীর জটিল অসুখে ১৯ বছরে ঝরে গিয়েছিল পিয়ানো-পাগল সোমক দত্ত। তার বাবা-মা গৌরীশঙ্কর ও সুজাতা পাঁচ লক্ষ টাকা দিলেন হাওড়ার বাগনানের বিবেকানন্দ শিক্ষা কেন্দ্রকে।

আগামীর গাছেদের মধ্যেই তখন আধফোটা কুঁড়ির স্বপ্ন ডালপালা মেলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE