রসিক: ঘরোয়া ওয়াইন সহযোগে জমে উঠেছে উৎসব।
দাদির আমলের চোখ জুড়োনো বয়ামগুলো সত্যিই রাজকীয়! দেখলেই রিপন স্ট্রিটে ছোটবেলার ‘ক্রিসমাস’ ভাসে মিশেল ডায়াসের চোখে।
আঙুরের শাঁস থেকে ফোঁটাফোঁটা তাজা রক্ত নিংড়ে ওই পোর্সেলিনের বয়ামেই মজানো হত মাসের পর মাস!
ঠাকুমা এমিল ডানকানের মতো শাশুড়ি সিন্থিয়া ডায়াসের কথাও বড্ড মনে পড়ে মিশেলের। কলকাতা ছাড়লেও ‘হোমমে়ড ওয়াইন’-এর ‘আর্ট’ ভোলেননি সিন্থিয়া। মিশেল ভাবেন, পরের বছর মেলবোর্নে শাশুড়িমায়ের সঙ্গে দেখা হলে বড়দিনের জন্য ঠিক কয়েক বোতল বাগিয়েই ফিরতে হবে কলকাতায়!
বেলাগাম ‘আবগারি মেজাজ’-এর সঙ্গে মিলবে না এই মদিরা-মহিমা। হুজুগে বাঙালিও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান-গোয়ানদের দেখাদেখি আঙুর, কিসমিস, কালোজামটামের ওয়াইন বানাতে শিখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু কলকাতার ‘কালো সাহেব’ ও মেমদের ঘরের মদিরা-চর্চা আদতে পরিবারের সবার গায়ে গা লাগিয়ে বাঁচার প্রতীক।
ঘরের ছেলেবুড়ো সক্কলে মিলে হাত লাগিয়েই সাজান ‘ক্রিসমাস ট্রি’, গড়ে ওঠে কেক, রোজকুকি বা মিষ্টি নিমকির আদলের কুলকুল! তেমনই গৃহপালিত মদিরার আশায় বড়দিনের ৭-৮ মাস আগে থেকে শুরু রাজসূয় যজ্ঞ। অধুনা কসবাবাসী ক্রেগ অ্যান্টনি শোনান, সব থেকে ভাল আঙুরটা মিলবে এপ্রিল-মে নাগাদ। তার রস নিংড়ে চলবে মজানো আর বারবার বয়াম থেকে বয়াম বা বোতল থেকে বোতলে ঢালার কসরত।
বারবার ঢালাঢালি বা ‘ডিক্যান্টেশন’ নিয়ে মা-বাপ ডোরিন ও হেনরির খুঁতখুঁতেপনায় ছোটবেলায় তিতিবিরক্ত হতেন ক্রেগ। এখন স্বর্গগত বাপমায়ের স্মৃতি জিইয়ে রাখতেই মদিরা-চর্চা জারি রেখেছেন তিনি। ক্রেগের বৌ ডেনিসও গর্বিত, ‘‘আমার শ্বশুরমশাইয়ের মতো ওয়াইন কেউ পারতেন না!’’ তখন খিদিরপুরের রেল কলোনিতে ব়ড়দিনে ডোরিন-হেনরির বাড়ি মানেই জ্ঞাতিগুষ্টিতে নরক গুলজার। শ্বশুরমশাইরা পাঁচ ভাই, শাশুড়িরা ছ’বোন মিলে সুরায় সুরায় টক্কর। হেনরি শুধু সেরা ওয়াইনটাই করতেন না, বাকি সবারটা একটু চেখে বলেও দিতেন, কোথায় কী গলদ! ‘‘এটা মজানোর সময়ে গোলমাল হয়েছিল, ওটা আর এক হপ্তা সময় দিলে খোলতাই হত!’’ চোখ বুজে রায় দিতেন ডাকসাইটে সুরাবিদ।
ক্রেগ ও ডেনিস।
নিয়মিত ওয়াইন-চর্চা চালু রাখলেও অ্যান্টনি পরিবার আসলে ব্যতিক্রম। বাঙালি-ঘরে পৌষের পিঠেপায়েস বিস্মরণের মতোই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের বারো আনাই আর এত হ্যাপা পোহাতে রাজি নন। বড়দিনের বচ্ছরকার ওয়াইন ছাড়াও বিয়ে বা বাচ্চাদের নামকরণ-অনুষ্ঠানে মদিরার দরকার পড়ে। এন্টালির লেস্টার জেনিংস, পিকনিক গার্ডেনের রিচার্ড পেরিরা বা সুজিদের মতো পেশাদার ওয়াইন মেকাররাই তখন ভরসা। বছর শেষে ভেতো বাঙালিও গুটিগুটি বৌবাজারের বো ব্যারাকে অ্যানা আন্টি, ভ্যালেরি আন্টিদের খোঁজ করে। তবে অনেকেরই অভিজ্ঞতা, বিশ্বস্ত ঠেক ছাড়া ‘মিষ্টি গুড়’ ওয়াইন তত পদের নয়।
কসবার ক্রেগ-ডেনিসেরা বোঝান, ভাল ওয়াইনের জন্য বহু আগে ‘অর্ডার’ দিতে হবে। এ তো দু’মিনিটের ‘ফাস্ট ফুড’ নয়! সময় নিয়ে মজাতে হবে। তার পরে বিশেষ কেতায় তরলকে লম্বা বিশ্রাম দিলেই খুলবে কষাটে মিষ্টি স্বাদ। খুঁটিনাটি নিয়ে ক্রেগ মুখ খুলতেই বরের দিকে চোখ পাকান ডেনিস। ‘‘এই লোকটা দেখি আমার রেসিপি সব ফাঁস করে দেবে!’’ কী ভাবে বয়াম ঢেকে রাখতে হবে, বিশ্রাম-পর্বে কখন বোতলে হাত দেওয়া যাবে বা যাবে না— পদে-পদে পোড়খাওয়া কত্তাগিন্নিদের তুকতাক।
কেউ কেউ রামটাম মেশালেও সাধারণত ঘরোয়া মদিরায় অ্যালকোহলের ভাগ যৎসামান্য। সে যুগে বছরভর ঘরে মজুত থাকত বাচ্চাদের সর্দিকাশির দাওয়াই, আদা বা জিঞ্জারের ওয়াইন। আলু দিয়েও মদিরা হত খোলতাই। রসিকজনের বিশেষ প্রিয় টেপারি (গুজবেরি) ও কালো আঙুরের ওয়াইন।
বিপুল মদিরার আশায় সাবেক বয়ামের বদলে ২০ লিটার জলের জেরিক্যান বেছে নেন কেউ কেউ। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের প্রিয় দোকান নিউ মার্কেটের ইয়াকুব মল্লিকে পুঁচকে সুদৃশ্য ওয়াইন গ্লাসের খোঁজ পড়ে। আর বছর শেষের রঙে-গন্ধে ফের জ্যান্ত হয়ে ওঠেন সেই সব আশ্চর্য করিতকর্মা দাদু-দিদা, নানা-নানিরা। সৌজন্যে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শৈলীর ঘরোয়া ‘ওয়াইন’!
ছবি: পূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy