এভারেস্ট শুধু স্বপ্নভঙ্গই নয়, স্বপ্নপূরণের শৃঙ্গও বটে।
এভারেস্ট ঘিরে নানা স্বপ্ন দেখেছে প্রবীণ প্রজন্ম। দেখছে এ প্রজন্মও। কিন্তু দুই প্রজন্মের বাস্তবে রয়েছে অনেক পার্থক্য।
২৯ মে ছিল ‘এভারেস্ট দিবস’। সেই উপলক্ষে শনিবার আইএমএফ (পূর্বাঞ্চল) এবং শহরের একটি পর্বতারোহণ ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে গল্পে গল্পে উঠে এল সে সব কথাই। ১৯৯১ সালের অভিযানের ফিল্ড ক্যাপ্টেন, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল অপূর্বকুমার ভট্টাচার্য, ১৯৯৩ সালের দলনেতা অমূল্য সেন থেকে শুরু করে নতুন প্রজন্মের দেবরাজ দত্ত, মলয় মুখোপাধ্যায়, সত্যরূপ সিদ্ধান্ত— উপস্থিত ছিলেন বাংলার পর্বতারোহণ পরিবারের অনেকেই। তুষারধস থেকে সরঞ্জাম হারানোর কথা, এ কালের সঙ্গে সে কালের পর্বত আরোহণের পার্থক্য— উঠল কত কথা!
প্রায় ৭০০০ মিটার উচ্চতায় অভিযানের সরঞ্জাম রেখে কিছুটা নীচে নেমে এসেছিলেন বাঙালি অভিযাত্রীরা। উদ্দেশ্য ছিল, পরিবেশের সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নিয়ে বাকি সরঞ্জাম নিয়ে শৃঙ্গের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু বিশাল তুষারধসে উপরে রেখে আসা সরঞ্জাম চোখের নিমেষে হারিয়ে যেতে দেখেছিলেন তারা। অভিযান অসমাপ্ত রেখেই ফিরতে হয়েছিল তাঁদের। সেটা ছিল ১৯৯১ সাল।
এর পরে ১৯৯৩। নর্থ ফেস দিয়ে ফের এভারেস্ট অভিযানের পথে গিয়েছিলেন আর এক দল বাঙালি। ৮২০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প তৈরির পরে খারাপ হতে শুরু করে আবহাওয়া। লক্ষ্য থেকে মাত্র ৬৫০ মিটার দূরে থেমে যেতে হয় তাঁদেরও।
২০১৫ সাল। এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে অভিযানে যাওয়া কয়েক জন বাঙালি যুবক দেখেছিলেন, নেপালের ভূমিকম্পে তুষারধসে ধূলিসাৎ হয়ে গেল এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। সেই সঙ্গে সে বারের মতো তাদের শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্নও।
তবে এভারেস্ট শুধু স্বপ্নভঙ্গই নয়, স্বপ্নপূরণের শৃঙ্গও বটে। তারই ফসল ২০০৪ সালে সত্যব্রত দাম ও ২০১০ সালে বসন্ত সিংহ রায় ও দেবাশিস বিশ্বাসের সফল আরোহণ। বাঙালির এভারেস্ট অভিযানের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সেই শৃঙ্গ ছোঁয়ার লক্ষ্যে বছরের পর বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছিলেন যে বাঙালি অভিযাত্রীরা, তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হল এ দিন। ২০১৬ সালের এভারেস্ট জয়ী এবং এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা রুদ্রপ্রসাদ হালদার বলছেন, ‘‘যাঁদের হাত ধরে এভারেস্ট অভিযানে জোয়ার এসেছিল, তাঁদের সম্মান দিতে এই আয়োজন।’’ প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মকে মিলিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিচ্ছেন ১৯৯৩ সালের অভিযাত্রী সুশান্ত মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘এ ভাবে আগে কেউ ভাবেননি।’’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে পারলেও আয়োজকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বসন্তবাবুও।
অতীতের হাত ধরে বর্তমান প্রজন্ম এভারেস্টের পথে পা বাড়ালেও এখন তা অনেকটাই ‘সহজ’ হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন প্রবীণদের একাংশ। অপূর্ববাবুর মতে, বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পর্বতারোহণ তার ‘চার্ম’ হারিয়েছে। তিনি বলছেন, ‘‘এখন আর অভিযাত্রীকে বিশেষ কিছু করতে হয় না। শারীরিক ভাবে ফিট আর টাকা থাকলেই হল।’’ সুশান্তবাবুও বলছেন, ‘‘পর্বতারোহণ এখন আর দলগত স্পোর্টস নেই। একক প্রচেষ্টা হয়ে গিয়েছে।’’ তবে টাকার কারণে ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতাও বেড়েছে বলে মত প্রবীণদের। ২০১৪-র কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে ছন্দা গায়েনের নিখোঁজ হওয়ার জন্য এই টাকার চাপকেই দায়ী করছেন তাঁরা। অপূর্ববাবুর মতে, ‘‘স্পন্সরদের চাপে একই অভিযানে একাধিক সামিট করার প্রবণতা বেড়েছে। শরীর ও মন তৈরি কি না, তা নজরে রাখা হচ্ছে না। ফলে বিপদ বাড়ছে।’’ তবে কি সহজে হচ্ছে সামিট? মানেন না বসন্তবাবু। তিনি বলেন, ‘‘পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে, তাই একটু সহজ হয়েছে ঠিকই। তবে শেরপা তো পিঠে করে চূড়োয় তুলে দেন না!’’
এই প্রসঙ্গে বসন্তবাবুর সঙ্গে একমত নবীন প্রজন্ম। রুদ্রপ্রসাদবাবুর মতে, ‘‘বাংলার পর্বতারোহণ শুধু এভারেস্টই আটকে নেই। পুরোনো পন্থায় ছোট-বড় অনেক শৃঙ্গ জয়ের চেষ্টা করছে অনেকে। এভারেস্টে শেরপাদের সঙ্গে নেওয়া এখন নেপালে বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছে।’’ ‘সেভেন সামিট’ জয়ী সত্যরূপ বলছেন, ‘‘টাকা একটা মাথাব্যথার কারণ বটে, কিন্তু পর্বতারোহণ মোটেই সোজা কাজ হয়ে যায়নি। তবে এখন শুধু পাহাড় চড়ার দিকেই ফোকাস রাখা যায় অন্য চিন্তা করতে হয় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy