Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ঘুরে এল বাঙালির পাঁপড়-পার্বণ

জগন্নাথের মেনুতে মালপো-পায়েস-খাজা-গজা-পোলাও যা-ই থাকুক, পাঁপড় ভাজার কিন্তু অস্তিত্ব শুনিনি। তবু সেই মুচমুচে আস্বাদ বিনা আমবাঙালির রথযাত্রায় কেন ফাঁক থেকে যায়?

স্বাদু: ভাজা হচ্ছে পাঁপড়। বুধবার, ধর্মতলায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

স্বাদু: ভাজা হচ্ছে পাঁপড়। বুধবার, ধর্মতলায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৯ ০১:১২
Share: Save:

দাদা বলরামই ভোজন-রসিক! ভাই জগন্নাথ অল্পে খুশি। তবু শ্রীক্ষেত্র পুরীর নায়ক তো তিনিই! আর ভক্তেরা মানেন, দফায় দফায় ভোগ-আস্বাদনেই পুরীতে অবতীর্ণ হন তিনি।

জগন্নাথের মেনুতে মালপো-পায়েস-খাজা-গজা-পোলাও যা-ই থাকুক, পাঁপড় ভাজার কিন্তু অস্তিত্ব শুনিনি। তবু সেই মুচমুচে আস্বাদ বিনা আমবাঙালির রথযাত্রায় কেন ফাঁক থেকে যায়?

কত কিছু বদল আমরা মেনে নিয়েছি। মাল্টিপ্লেক্সে গা-জ্বালা ধরানো দামে মেক্সিকান পাঁপড় নাচোস খাচ্ছি সোনা মুখে। সেই বাঙালিই রথের মেলার নিরাভরণ পাঁপড়ে কী পরমার্থ খুঁজে পায়! ‘‘রথের মেলার পাঁপড়ে একান্তই বাঙালির নিজস্ব উৎসবের মেজাজ!’’— বলছিলেন মাহেশের জগন্নাথদেবের প্রধান সেবায়েত চৈতন্যদেবের সহচর কমলাকর পিপলাইয়ের উত্তরপুরুষ তমালকৃষ্ণ অধিকারী।

৬৩২ বছরের পুরনো মাহেশের রথ বা ৩০০-৪০০ বছরের মহিষাদল, গুপ্তিপাড়ার রথের মেলাতেও পাঁপড়ের মহিমা উজ্জ্বল। কলকাতার রথের মেলা-মানচিত্র জুড়েও পাঁপড় আর পাঁপড়। ‘‘এ পাঁপড় যে সে পাঁপড় নয়! এতেও আধ্যাত্মিক আনন্দের রূপক।’’— শোনালেন মার্বেল প্যালেসের রাজেন্দ্র মল্লিকের বংশের উত্তরপুরুষ হীরেন্দ্র মল্লিক।

রথের আগে স্নানযাত্রায় গজানন বা গণেশ রূপে অবতীর্ণ হন জগন্নাথদেব। রথে তাঁর মানবলীলায় ফেরার তোড়জোড়। স্নানযাত্রার পরে সটান গর্ভগৃহে ঢুকে যান জগন্নাথ। ঘড়া ঘড়া জল গায়ে ঢেলে বা বৃষ্টিতে ভিজে তাঁর দেহে উত্তাপ দেখা দেয়। এই জ্বরজারিও ঠাকুরের মানব-জীবনের অঙ্গ। জগন্নাথদেবের সেবার উপকরণ-প্রণালী জুড়ে লেখা, জ্বর সারলে কোন পথ্যিতে প্রভুর রুচি ফিরবে। তাতে ছোলা, মিছরি, পলতা পাতার রস এবং মুখরোচক পলতা পাতা ভাজার কথা রয়েছে। হীরেনবাবু বলছিলেন, ‘‘রোগভোগের লীলা সেরে সুস্থ দেহে মানবিক বাসনায় মেতে ওঠাও ঠাকুরের লীলা। আর কে না জানে, এই বাসনার সেরা বাসা সেই রসনায়। সুখাদ্যের স্পর্শে জিভের আড় ভাঙলেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে মন্দির থেকে বেরিয়ে রথে দুনিয়া দেখার তাড়না সঞ্চারিত হয় প্রভুর মধ্যে! রথের মেলার মুখরোচক পাঁপড়-জিলিপির স্বাদে সেই দিব্য আনন্দেরই স্মারক!’’

সিমলেপাড়ার নকুড় নন্দীর দোকানেও রথ বেরোবে আজ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। তবে দোকানের সন্দেশই জগন্নাথদেবকে দেওয়া হবে। রিষড়ার ফেলু ময়রা স্রেফ রথ আর উল্টোরথে ঘিয়ে ভাজা মজানো ডালে হাল্কা টক স্বাদের বাঙালি জিলিপি করেন। হীরেনবাবুর ব্যাখ্যায়, ‘‘পাঁপড়ের কথা জগন্নাথ সেবার ফিরিস্তিতে না থাকলেও জিলিপি মহাপ্রসাদের অঙ্গ। মাসির বাড়ি যাত্রার পরে ভোগ-নিবেদন পর্বে চামর দুলিয়ে মালপো খাবেন জগন্নাথ। শেষে মুখশুদ্ধির জন্য জিলিপি, পান, সুপুরিই দেওয়া হয়!’’ বাস্তবিক, জিলিপিকে ভরা পেটে একেবারে শেষ পাতেও অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করতেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। আর পাঁপড়ও বাঙালি ভোজ শেষের মুখে টাকরায় রুচি ফেরাতে খেয়ে থাকে।

মেলার সাদামাটা পাঁপড় ভাজা অতএব সাধারণ হয়েও ফেলনা নয়! জগন্নাথ-উৎসবে ভাজাভুজি, ভোজটোজ সবই অতি গুরুত্বপূর্ণ। মাহেশের জগন্নাথের প্রতিষ্ঠাতা ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরীর ঠাকুরকে নিজহাতে ভোগরাগ নিবেদন করতে চেয়েছিলেন। পান্ডারা বাধা দেন। সেই অভিমানেই পরে জগন্নাথের স্বপ্নাদেশে মাহেশে বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা। বিশ্বাসীর চোখে, বাঙালির পাঁপড়ভাজা পার্বণ জুড়েও ঈশ্বরের ভোগ-বিভূতিই একাকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Papad Jagannath Puri Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE