Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নেতার ফোন শিল্পীকে

খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। সংস্কৃতির অঙ্গনে শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার যে অভিযোগ এক সময়ে উঠেছিল বাম শাসকদের বিরুদ্ধে, এ বার তৃণমূল জমানায় সেটাই একেবারে ‘সেমসাইড’।

হুমকি। অ্যাকাডেমিতে সনাতন দিন্দার প্রদর্শনীর সামনে। — নিজস্ব চিত্র

হুমকি। অ্যাকাডেমিতে সনাতন দিন্দার প্রদর্শনীর সামনে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৩৩
Share: Save:

খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি।

সংস্কৃতির অঙ্গনে শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার যে অভিযোগ এক সময়ে উঠেছিল বাম শাসকদের বিরুদ্ধে, এ বার তৃণমূল জমানায় সেটাই একেবারে ‘সেমসাইড’।

পরিবর্তনের মুখ হয়ে যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আনার জন্য পথে নেমেছিলেন, তাঁদেরই এক জন চিত্রকর সনাতন দিন্দা। এবং সেই সনাতনের তোলা একটি ভিডিও ছবির প্রদর্শন আটকাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তৃণমূলেরই একদল কর্মী-সমর্থক। সঙ্গে লাঠিয়াল পুলিশ।

মঙ্গলবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে এই ঘটনার পরেই চার দিকে প্রতিবাদ এবং ধিক্কার শুরু হয়ে যায়। নির্বাচন চলাকালীন এ ধরনের ঘটনা জনমতকে কী ভাবে প্রভাবিত করে, গত দু’দিনে তার নজির ধরা পড়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বুধবার রাতেই সনাতন দিন্দার কাছে জনৈক তৃণমূল নেতার ফোন যায়, ‘তোর কী হয়েছে রে?’ ঘটনার কথা শুনে নেতার প্রতিক্রিয়া, ‘চিন্তা করিস না। ভোটের শেষে মিটিয়ে নেব।’

তিনি মিটিয়ে নেবেন কি না, সে পরের কথা। কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনা বলতে গিয়ে বুধবার প্রথম দিকে সনাতনকে যতটা আক্রমণাত্মক দেখা গিয়েছে, পরে ধার কমেছে সেই আক্রমণের। সনাতন ওই রাতে জানান, ভিডিও প্রদর্শনী বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু পরে ভিডিও দেখে পুলিশকর্মীরা সন্তুষ্ট হন। তার পর থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ভিডিও চলে।

পিছু হটছেন সনাতন? তাঁর এক সময়ের ঘনিষ্ঠতার মূল্য দিচ্ছেন? মানতে চাননি চিত্রকর। তাঁর কথায়, ‘‘আমি রাজনীতি করি না। এক সময়ে পরিবর্তন চেয়ে মিছিল করেছি। নন্দীগ্রাম-খেজুরি গিয়েছি। এখন যেটা চলছে, সেটা তো গণতন্ত্র নয়।’’

এই প্রসঙ্গে অনেকের মনে পড়ছে কাম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট নেতা পল পটের কথা। যিনি নিজের ঢাক পিটিয়ে আত্মজীবনী লেখার জন্য আমেরিকার এক সাংবাদিককে ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু পল পটেরই অনুচরদের হাতে প্রাণ যায় সেই সাংবাদিকের। সনাতনের ঘটনা তার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও অনেকের সূক্ষ্ম মন্তব্য, ‘‘আসলে ব্যাপারটা এক জায়গায় মিলে যায়। যাঁর জয়ঢাক বাজাতে এক সময়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন সনাতন, আজ তাঁরই অনুচরদের হাতে হেনস্থা হচ্ছেন তিনি।’’

তবে তিনি রাজনীতি না করার দাবি করলেও নিজেই জানিয়েছেন, কলকাতা পুরসভার শেষ নির্বাচনে কসবায় তৃণমূলের প্রার্থী সুশান্ত ঘোষের হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন। পরিবর্তনের জমানায় তৃণমূলের সুব্রত বক্সীর হয়েও প্রচার করেছেন তিনি। পুজোর সময়ে প্রতিমা গড়ার পরে তুলি তুলে দিয়েছেন নেত্রীর হাতে, প্রতিমার চক্ষুদানের জন্য। সে ঘটনাও খুব বেশি পুরনো নয়।

আচমকাই কেন ভেঙে পড়া বিবেকানন্দ সেতুর ভিডিও নিয়ে সম্পর্কে ফাটল দেখা দিল? সনাতনের কথায়, ‘‘বেশ কিছু দিন হল দূরত্ব বেড়েছে।’’ তাই কি হেনস্থা?

ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই হেনস্থার নিত্যনতুন বয়ানও পাওয়া যাচ্ছে। সনাতন বলছেন, ‘‘পুলিশ এসে বন্ধ করে দেয় ভিডিও। সেই সময়ে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে অ্যাকাডেমির তৃণমূল-কর্মীরা আঙুল তুলে ‘নোংরামো’ হচ্ছে বলে চেঁচাচ্ছিলেন।’’ কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মুরলীধর শর্মা বলেন, ‘‘অ্যাকাডেমির সামনেই আমাদের পুলিশের কিয়স্ক। সেখানে খবর আসে গণ্ডগোল হচ্ছে। আমাদের অফিসার ছুটে গিয়ে তা মেটানোর চেষ্টা করেন। পুলিশ যাওয়ার আগেই ভিডিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে থানা থেকে অফিসারেরা গিয়ে দু’দলের মধ্যে গণ্ডগোল মিটিয়ে দেন। ভিডিও দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসেন।’’

গণ্ডগোলের আঙুল যাঁর দিকে, অ্যাকাডেমি কর্মীদের নিয়ে তৈরি তৃণমূলের সেই ইউনিয়নের সম্পাদক সন্তোষ দাস অবাক হয়ে বলেন, ‘‘আমরা! আপত্তি করেছি! কেন? শনিবার থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। সে দিন থেকেই ভিডিও দেখানো হচ্ছে। আমরা আপত্তি করলে তো সে দিনই করতে পারতাম।’’ তা হলে কারা গণ্ডগোল পাকালেন? সন্তোষবাবু জানিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনিও নাকি কিছু জানেন না। তাঁর দাবি, গণ্ডগোলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি শুনেছেন, পুলিশ ভিডিও বন্ধ করার কথা বলেছে। সনাতন জানিয়েছেন, তাঁকে যে বড় মাপের নেতা ফোন করেছিলেন, তিনি প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।

সেই খবর কি সন্তোষবাবুদের কাছে পৌঁছেছে? দলের তরফে কোনও নির্দেশ? সন্তোষজনক কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে প্রতিবাদ যে থামছে না, তার আঁচ পাওয়া গিয়েছে। আজ, শুক্রবার অ্যাকাডেমির সামনে প্রতিবাদে সামিল হতে চলেছেন শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা। সনাতন বলেন, ‘‘যে কেউ আসতে পারেন।’’

চলচ্চিত্র-গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় সে দিন ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘সে দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমেই বলে, তাঁদের কাছে নাকি অভিযোগ এসেছে যে এখানে রাজনৈতিক প্রচার হচ্ছে। নির্দেশ আছে, বিষয়টি উপরে জানাতে হবে।’’ সনাতনবাবু অবশ্য এই কথাটিও বলেননি।

আরও পড়ুন, পরিবর্তনে সামিল ছিলাম, এখন আমারই হেনস্থা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanatan dinda trinamool TMC west bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE