Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

কংক্রিটের মাঝে সবুজ হারিয়ে ছায়াহীন নগরী

প্রয়োজন ১৫ শতাংশ। রয়েছে সাকুল্যে সাড়ে তিন। কলকাতাকে লন্ডনে রূপান্তরের আগে শহরে সবুজায়নের প্রশ্নে এমনই হোঁচট খেল রাজ্য সরকার। দেশের সাতটি মহানগরের বাড়-বৃদ্ধি, সৌন্দর্যায়ন এবং তার সবুজায়নের বিবরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অনুমোদিত একটি সংস্থা সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে এ শহরে গাছগাছালির পরিসংখ্যান এমনই করুণ। তালিকায় শেষ জায়গাটা কলকাতার।

উন্নয়নের কাজে কোপ পড়েছে গাছে। সবুজহীন ইএম বাইপাস। ছবি: সুমন বল্লভ।

উন্নয়নের কাজে কোপ পড়েছে গাছে। সবুজহীন ইএম বাইপাস। ছবি: সুমন বল্লভ।

রাহুল রায়
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪৯
Share: Save:

প্রয়োজন ১৫ শতাংশ। রয়েছে সাকুল্যে সাড়ে তিন।

কলকাতাকে লন্ডনে রূপান্তরের আগে শহরে সবুজায়নের প্রশ্নে এমনই হোঁচট খেল রাজ্য সরকার।

দেশের সাতটি মহানগরের বাড়-বৃদ্ধি, সৌন্দর্যায়ন এবং তার সবুজায়নের বিবরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অনুমোদিত একটি সংস্থা সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে এ শহরে গাছগাছালির পরিসংখ্যান এমনই করুণ। তালিকায় শেষ জায়গাটা কলকাতার।

ওই মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তার টিপ্পনি, ‘‘ছায়া হারিয়েছে কলকাতা।’’ জানাচ্ছেন, পশ্চিম থেকে পূর্ব— শহর ফুঁড়ে আড়াআড়ি মেট্রোর সম্প্রসারণ, পূর্ব-দক্ষিণে প্রলম্বিত ইএম বাইপাসের প্রসার, একের পর এক উড়ালপুল আর ক্রমান্বয়ে রাস্তা সম্প্রসারণের ধাক্কায় কলকাতা শহর থেকে আমূল হারিয়ে গিয়েছে ‘সবুজ’। এর সঙ্গে দোসর, নগরায়ণের অবিরাম ধাক্কা, যার জেরে পাল্লা দিয়ে জেগে উঠছে বহুতলের জঙ্গল।

শহর কলকাতার এই ‘উন্নয়নের’ পরিসরে যেটুকু সবুজ, বছর কয়েক আগেও তা কোনওক্রমে টিকে ছিল কলকাতার হৃদ্‌পিণ্ড ময়দান এবং শহরের অপরিসর রাজপথের দু’ধারে। ছায়াহারা কলকাতায় এখন সেই সবুজের আচ্ছাদন সাকুল্যে ৩.৫৭ শতাংশ। বাকিটা কংক্রিটের দখলদারি।

এ শহরে রাধাচূড়া থেকে পলাশ, ছাতিম থেকে মোহনচূড়ার ছায়া হারিয়ে গিয়েছে গত চার বছরে। সে পথে এখন নীল-সাদা বাহারি বুলেভার্ডের অনুশাসন আর রাস্তার দু’পাশে আড়শ্যাওড়ার ঝোপ, বাতিল যন্ত্রাংশের স্তূপ আর টিনের বোর্ডে ঘন ঘন সরকারি দুঃখপ্রকাশ—‘আজকের যন্ত্রণা কালকের আনন্দ’।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের পরিসংখ্যানে তেমন আমল দিতে রাজি নন। সম্প্রতি বন দফতরের এক অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, পরিবর্তনের পরে পথেঘাটে নতুন করে গাছ-গাছালি লাগানোয় আগের তুলনায় অনেক বেশি ‘সবুজ’ হয়ে উঠেছে কলকাতা।

আর বাস্তব কী বলছে? পূর্ব কলকাতার নজরুল ইসলাম সরণি (ভি আই পি রোড), ফুলবাগান, উত্তরের বেলগাছিয়া, নাগেরবাজার এলাকা বা দক্ষিণমুখী সত্যজিৎ রায় সরণি (ইএম বাইপাস), পার্ক সার্কাস কানেক্টর বা পশ্চিম কলকাতার জেমস লং সরণি এখন গাছগাছালি-শূন্য আদ্যন্ত এক ন্যাড়া চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বন দফতরের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘নগরায়ণের ধাক্কায় সবুজ হারিয়ে যাওয়ায় শহরে বেড়ে গিয়েছে ধূলিকণার মাত্রা। বাড়ছে অত্যধিক মাত্রায় বায়ুদূষণ।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত কর্তা তথা পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘কলকাতার রাস্তা জুড়ে বড় মাপের গাছগাছালিই এত দিন এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করত। সে দিন হারিয়ে গিয়েছে।’’ চৈত্র মাসের রোদেই তাই গলছে পিচ। শহর জুড়ে বাড়ছে হাঁচি-কাশি-হাঁপানির প্রকোপ।

পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘সূর্যের উত্তাপ এত কাল ঢাকা পড়ে েযত গাছের ছায়ায়। সরাসরি সেই উত্তাপ পিচের রাস্তায় না পড়ায় এত দ্রুত পিচ গলে যেত না। এখন বিকিরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভাল করে গরম পড়ার আগেই অ্যাসফল্ট গলে পাঁক হয়ে যাচ্ছে।’’

আর, শহরের পরিচিত বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ স়ঞ্জয় ঘোষের মন্তব্য, ‘‘এক মুঠো তাজা বাতাসের জন্য হাঁফিয়ে মরছে কলকাতা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ।’’

শহরে সবুজায়নের দায় যাদের, বৃক্ষনিধনের অনুমোদনও দেয় তারাই— বন দফতর। এই সবুজহীনতার মাঝে বন আইন বলছে, একটি গাছ কাটলে পরিবর্তে সেই ধরনের আরও পাঁচটি গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে, যে পরিসরে চলছে নির্মাণকাজ, সেখানে গাছ কাটা হোক বা না হোক, প্রকল্প শেষে মোট জমির অন্তত ২০ শতাংশ ছেড়ে দিতে হবে গাছ লাগানোর জন্য। কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গল সে আইন মানছে কি?

বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন আশ্বস্ত করছেন, ‘‘অবশ্যই মানা হচ্ছে।, সরকারি-বেসরকারি যে কোনও সংস্থা যে উদ্দেশ্যেই গাছ কাটুক না কেন, বন বিভাগের ফরেস্ট ইউটিলাইজেশন শাখার অনুমোদন একান্ত কাম্য।’’ তিনি জানান, শুধু গাছ কাটাই নয়, পরিবর্তে বন আইন মেনে ওই এলাকায় গাছ লাগানো হয়েছে কি না, তার নজরদারিও করে ওই বিভাগ।

গত সাত বছরে (২০০৮-২০১৪) ওই বিভাগের অনুমোদন পেয়েছে ৮৩২টি প্রকল্প। যার ৩০ শতাংশই সরকারি প্রকল্প। সেই সব প্রকল্পে নতুন গাছ লাগানো হয়েছে কি?

নিয়মানুযায়ী, যে ধরনের গাছের উপরে কোপ পড়ল, ঠিক সেই ধরনের গাছই ওই এলাকায় রোপণ করার কথা। পরবর্তী তিন বছর সে সব চারাগাছের দেখভালের দায়ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার। বন আইনের ছায়ায় কি ভরসা পাচ্ছে কলকাতার গাছগাছালি?

পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগের প্রধান তথা রাজ্য কৃষি দফতরের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আবহাওয়াবিদ স্বদেশরঞ্জন মিশ্র এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখছেন আরও একটি শঙ্কার কথা— নগরায়ণের ধাক্কায় প্রবল খাদ্যসঙ্কটে ভুগছে শহরের গাছগাছালি। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বহুতলের ভিড় শহরে গাছ পড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। রাস্তার দু’ধারে গাছগাছালির চেয়ে কংক্রিটের জঙ্গলের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে। ঝড়-বৃষ্টির মতো দুর্যোগের সময়ে ঝোড়ো বাতাস বহুতলে ধাক্কা খেয়ে ওই রাস্তা বরাবর ছুটতে থাকে। হাওয়ার গতিও সে সময়ে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সেই সময়ে ওই সব রাস্তায় যে ‘টানেল এফেক্ট’ তৈরি হয় তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ওই অপুষ্ট, বয়স্ক গাছগাছালির নেই। তারা সমূলে পড়ে যায়।”

তা হলে উপায়? তারই উত্তর হাতড়াচ্ছে ছায়াহীন মহানগর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE