Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ডান হাত হারিয়ে বাঁ হাতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে একরত্তি

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান, ওষুধ খাওয়া সেরে বই নিয়ে বসছে সে। তবে পড়ার থেকে বেশি সময় কাটছে লিখে। রুল টানা খাতায় ঘণ্টাখানেক লেখার পরে সে খুলে বসছে আঁকার খাতা।

সাহসী: বাঁ হাতে লেখার অনুশীলনে মগ্ন পৃথা। শনিবার, গোবরডাঙায়। নিজস্ব চিত্র

সাহসী: বাঁ হাতে লেখার অনুশীলনে মগ্ন পৃথা। শনিবার, গোবরডাঙায়। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০১:২১
Share: Save:

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান, ওষুধ খাওয়া সেরে বই নিয়ে বসছে সে। তবে পড়ার থেকে বেশি সময় কাটছে লিখে। রুল টানা খাতায় ঘণ্টাখানেক লেখার পরে সে খুলে বসছে আঁকার খাতা। আঁকাবাঁকা রেখায় তাতেই ফুটে উঠছে আম, বেগুন, গোলাপ। কখনও আবার একটি মেয়ের ছবি!

পথ দুর্ঘটনায় ডান হাত কাটা যাওয়া পৃথা সরকার এখন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে বাঁ হাতে লেখার ও ছবি আঁকার। গোবরডাঙার বাসিন্দা সেই মেয়ে বলছে, ‘‘কাকাই আমাকে বাঁ হাতে লেখা শিখিয়ে দিয়েছে। নিজেকে চেষ্টা করতে বলেছে। যত চেষ্টা করব, তত ভাল হবে। এখন আমি আঁকতেও পারছি!’’ একরত্তি মেয়ের কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো পিসি তৃপ্তি মণ্ডলের চোখে জল। তিনি বললেন, ‘‘এইটুকু মেয়ে, এ ভাবে কত দিন পারবে? কাঠের হাত কিনে দেওয়ার টাকাও নেই আমাদের।’’

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্কুলে যাওয়ার পথে পৃথাদের অটো উল্টে যায়। পৃথার সঙ্গে আরও কয়েক জন পড়ুয়া ছিল সেই অটোয়। ওই দুর্ঘটনার কিছু আগেই ‘ড্রাইভারকাকু’র পাশে বসবে বলে চালকের ডান দিকে গিয়ে বসেছিল পৃথা। একটি কুকুর সামনে পড়ে যাওয়ায় চালক জোরে ব্রেক কষলে অটোটি উল্টে যায়। কনুই থেকে কেটে গিয়ে ঝুলতে থাকে পৃথার ডান হাত।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গোবরডাঙা এবং বারাসতের তিনটি হাসপাতালে ঘোরার পরে মেয়েটিকে কলকাতার হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকেরা। অ্যাম্বুল্যান্সের চালক রাস্তা না চেনায় সমস্যায় পড়ে পৃথার পরিবার। ইউ এন ব্রহ্মচারী স্ট্রিটের এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে কলকাতার রাস্তায় গুরুতর আহতকে নিয়ে ঘুরতে থাকেন চালক। পরে ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পৃথাকে। সেখানেই অস্ত্রোপচারের পরে ডান হাতটি কাটা যায় পৃথার।

হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পরে মেয়েকে শান্ত করতেই নাজেহাল হতে হয়েছিল পৃথার পরিবারকে। সদ্য হাত কাটা যাওয়া মেয়ে চেঁচাতে শুরু করে, ‘‘আমার হাতটাই তো আর নেই। লিখব কী করে?’’ সেই সময়ে পৃথার কাকা তপন সরকার বাঁ হাতে লেখা শিখিয়ে দেওয়ার কথা বলে শান্ত করে মেয়েকে।

পৃথার বাবা স্বপন সরকার নির্মাণস্থলের কর্মী। পৃথার এক দিদি ও এক ভাই রয়েছে। তবে বাবা-মায়ের টানাটানির সংসারে ভাইঝিকে রাখতে চাননি পৃথার পিসি তৃপ্তি।

হাসপাতাল থেকে নিজের বাড়িতেই পৃথাকে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। তবে হাতের জন্য এখনও সে স্কুলে যেতে পারছে না। লেখা আর ছবি আঁকার পাশাপাশি প্রিয় কার্টুন দেখে সময় কাটে তার। শনিবার পিসির বাড়ি থেকে পৃথা বলে, ‘‘হাতটা থাকলে ভাল হত। লিখতে একটু একটু অসুবিধা তো হচ্ছেই। লাইন বেঁকে যাচ্ছে।’’ জানাল, এর মধ্যে এক দিন সে নিজের হাত না থাকা অবস্থার একটি ছবি আঁকার চেষ্টা করছিল। তবে আঁকতে গিয়ে ভুল হয়ে গিয়েছে। পৃথার কথায়, ‘‘আমার তো ডান হাত নেই। যে মেয়েটাকে এঁকেছি, তার

ডান হাতটা নেই দেখাতে গিয়ে ভুল করে বাঁ হাতটাই বাদ দিয়ে দিয়েছি!

এক দিন আবার ঘোড়া আঁকতে গিয়ে ভুল করে গাধা এঁকে ফেলেছি।’’ তার পিসি অবশ্য বলছেন, ‘‘যত ইচ্ছে ভুল করুক। তবু স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক আমাদের মেয়ে।’’

পৃথার সঙ্গে আবার নিজের অনেক মিল পাচ্ছে সুভাষগ্রামের কিশোরী অঞ্জলি রায়। ক্যানসারে বাঁ পা বাদ যাওয়ার পরেও নাচ ছাড়তে চায়নি

সে। এক বেসরকারি সংস্থা তার জন্য কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিলেও মনের জোরে অঞ্জলি এক পায়েই নাচা শুরু করে। এখন এক পায়েই মঞ্চ কাঁপাচ্ছে বছর ষোলোর সেই মেয়ে। পৃথার কথা শুনে অঞ্জলি বলে, ‘‘বোনটার সাহস আছে বলতে হবে। চেষ্টা যেন না ছাড়ে। সকলে এক দিন দেখবে, বাঁ হাতেই ও দারুণ আঁকছে। আমাদের কোনও কিছুই আটকাতে পারবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Street Accident Pritha Sarka
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE