Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
West bengal Municipal Election 2020

শোভনের পর ববি, মেয়র হিসেবে চাই বলে পোস্টার পড়ল কলকাতায়

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়-সহ উত্তর কলকাতার বেশ কিছু জায়গায় ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে এই ব্যানারটি চোখে পড়ে শনিবার দুপুর থেকে।

ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে এই পোস্টারেই ছেয়ে গিয়েছে উত্তর কলকাতা। —নিজস্ব চিত্র।

ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে এই পোস্টারেই ছেয়ে গিয়েছে উত্তর কলকাতা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২০:১৮
Share: Save:

কলকাতার পুরভোটের মুখে, ‘শোভনদা’কে ফিরে আসার আহ্বানের দিন তিনেকের মধ্যেই, ‘ববিদা’কেই আবার মেয়র চেয়ে ব্যানার পড়ল কলকাতায়।

বৃহস্পতিবার রাতে গোটা দক্ষিণ কলকাতা ছেয়ে গিয়েছিল ‘শোভনদা ফিরে আসুন’ ব্যানারে। বিজেপির পদ্ম ছাপ দেওয়া সেই ব্যানারে কোনও দলের বা ব্যক্তির নাম ছিল না, ছিল ‘কলকাতার নাগরিক বৃন্দ’। শুক্রবার দিনভর তা নিয়ে সরগরম থেকেছে কলকাতার রাজনীতি। আর তার পরই, শনিবার, উত্তর কলকাতা জুড়ে ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে দেখা গেল পাল্টা ব্যানার। তাতে লেখা, ‘ববিদাকেই আবার চাই’। এখানেও কোনও দলের নাম নেই। লোগোও নেই। প্রচারক হিসেবে ‘কলকাতার নাগরিক বৃন্দের পক্ষ থেকে’ যে নাম দেওয়া হয়েছে, সে নামে চেতলা অঞ্চলে ফিরহাদের ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতা রয়েছেন।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়-সহ উত্তর কলকাতার বেশ কিছু জায়গায় ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে এই ব্যানারটি চোখে পড়ে শনিবার দুপুর থেকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং‌ ফিরহাদ হাকিমের ছবি-সহ ওই ব্যানারে একদম উপরে লেখা রয়েছে, “ধন্যবাদ কলকাতা মহানাগরিক মাননীয় শ্রী ববি হাকিম মহাশয়কে এক বছরের মধ্যে কলকাতাকে বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়ে এক অনন্য থেকে অনন্যতম নজির গড়ার জন্য। আপনার অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতাকে জানাই কুর্ণিশ ও ধন্যবাদ, যার জন্য কলকাতা কর্পোরেশন পুনরায় তার স্ব-গরিমায় মানুষের সেবায় বিরাজ করছে।’’ ব্যানারের নীচে দু’বার লেখা— ‘ববিদাকে আবার চাই’।

আরও পড়ুন: শোভনের ব্যানার দেখে ‘টেনশন হচ্ছে’ ববির, কটাক্ষ দিলীপ ঘোষের​

বৃহস্পতিবার রাতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নামে যে ব্যানার পড়েছিল, তাতে কোথাও বলা হয়, ‘‘কলকাতার বেহাল দশাকে পুনরায় স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে আপনি এগিয়ে আসুন শোভনদা।’’ কোনওটায় আবার বলা হয়, ‘‘অসম্পূর্ণ কলকাতার পৌরসভাকে পুনরায় স্বমহিমায় আনতে ফিরে আসুন শোভনদা।’’

তাঁর পূর্বসূরী মেয়রকে নিয়ে ওই পোস্টারে ফিরহাদ কি বিচলিত? এ প্রশ্ন উঠেছিল। ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষের কটাক্ষ নস্যাৎ করতে অভ্যস্ত ফিরহাদ, ওই ব্যানার দেখে নিজের বিরক্তি আড়াল করেননি। বলেছিলেন, “আমার আমলে যে সংস্কারগুলো হয়েছে, সেগুলো তো বিরোধীরা বলবেন না। যে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে, কাউকে ধরাধরি করতে হচ্ছে না, সে সবও তো বলবেন না বিরোধীরা।’’ কলকাতা পুরসভাকে এই মুহূর্তে দেশের সেরা পুরসভা বলেও উল্লেখ করেন ফিরহাদ। শোভনের সঙ্গে নিজের কার্যকালের তুলনায় না গিয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢাল করে বলেন, ‘‘কলকাতার উন্নয়ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় হচ্ছে। সুতরাং কলকাতা পুরসভা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।’’

এ দিন উত্তর কলকাতায় যে ব্যানার দেখা গেল, তাতে ফিরহাদের সেই সব কথারই যেন প্রতিফলন। কিন্তু ফিরহাদ হাকিমের অনুগামীরা নিজেদের মতো করেই এই ব্যানার লাগালেন, নাকি তৃণমূল নেতৃত্বের নির্দেশে শোভনের ব্যানারের পাল্টা ব্যানার লাগানো হল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। টেলিফোনে প্রশ্ন করলে, এ ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই বলে দাবি করেছেন ফিরহাদ হাকিম নিজে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দলের সৈনিক। এ সব ভোটের বিষয় দল ঠিক করবে। দল থেকে যে লিস্ট বেরোবে, তাতে সব কিছু স্পষ্ট হবে।’’

আরও পড়ুন: ‘শোভনদা’ নামছেন পুরভোটে? পদ্মের ব্যানারে রাতারাতি ছয়লাপ গোটা দক্ষিণ কলকাতা​

ফিরহাদ যাই বলুন, তাঁর পক্ষে ছাপানো এই ব্যানারে তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়বে বই কমবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ টানা ১০ বছর কলকাতা পুরসভা তৃণমূলের দখলে, যার মধ্যে সাড়ে ৮ বছর সামলেছেন শোভন। বিজেপির তরফে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তা হলে কি ওই সাড়ে ৮ বছর কোনও কাজই করেননি শোভন? কাজ যদি না হয়ে থাকে, তা হলে শোভনকে দায়িত্বে রাখা হয়েছিল কেন?

তৃণমূল সূত্রে খবর, ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরামর্শ দিয়েছেন— ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র হিসাবে প্রজেক্ট করে এ বার কলকাতা পুরভোটে না যাওয়ার। মমতা সেই পরামর্শ মানবেন কি না পরের বিষয়। তবে ফিরহাদ হাকিমকেই মেয়র হিসাবে তুলে ধরে ভোটে যাওয়া হচ্ছে, এমন কোনও ঘোষণাও করেননি তৃণমূল নেত্রী। ফিরহাদকে নিয়ে তাঁর দলের শীর্ষস্তরের নেতাদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। সুতরাং শোভনের নামে ব্যানার পড়ার দু’দিনের মধ্যেই ফিরহাদকে তুলে ধরে যে ব্যানার দেওয়া হল, তা শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি বলেই মনে করছেন তৃণমূলের নানা স্তরের নেতারা। তাঁদের দাবি, ফিরহাদ হাকিমকেই আবার মেয়র চাই, এ রকম কোনও প্রচার দলের তরফ থেকে তুলে ধরার নির্দেশ আসেনি।

কলকাতা পুরসভার একাধিক মেয়র পারিষদ এই ব্যানার নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্যই করতে রাজি হননি। দলের অন্যতম মুখপাত্র তথা রাজ্যের মন্ত্রী তাপস রায় বলেন, ব্যানারের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে ‘বিজেপির তরফে’ যে ব্যানার ছাপানো হয়েছিল, তার পাল্টা প্রচারের জন্য কি ফিরহাদকে নিয়ে ব্যানার ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল? এই প্রশ্নের জবাবে তাপস রায় বলেন, “এ রকম কোনও সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা নেই।” অর্থাৎ দল নয়, মেয়র অনুগামীরাই যে এখন ফিরহাদকে আবার মেয়র পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরতে সক্রিয় হয়েছেন, তা স্পষ্ট। এটা দলীয় শৃঙ্গলাভঙ্গ কি না, তার কোনও জবাব দিতে চাননি তাপস।

ফিরহাদকে মেয়র চেয়ে যে ব্যানার ছাপানো হয়েছে, তা নিয়ে খোঁচা দিতে শুরু করেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপির সহ সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলছেন, ‘‘তৃণমূলের ব্যানার কারা ছাপাচ্ছে, কার নির্দেশে ছাপাচ্ছে, আমি বলতে পারব না। তবে এটা ছোট রাজনীতি।’’ এখানেই থামছেন না জয়প্রকাশ। ফিরহাদকে তৃণমূলের সবাই মেয়র হিসাবে চাইছেন কিনা, সে প্রশ্নও ঘুরিয়ে তুলেছেন। বলেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বার বার একটা কথা বলতে শুনছি। তিনি বলছেন, শোভনের সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসা উচিত। কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায় তো এখন বিজেপিতে রয়েছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো বিজেপি করেন না, তৃণমূল করেন। অন্য দলের এক জন রাজনীতিককে সক্রিয় হতে তা হলে কেন বলছেন পার্থবাবু? তিনি তো তৃণমূলের হয়ে শোভনকে সক্রিয় হতে বলেননি। শুধু সক্রিয় হতে বলেছেন। অর্থাৎ শোভন চট্টোপাধ্যায় এখন সক্রিয় হলে ফিরহাদ হাকিম চাপে পড়ে যাবেন, এটা জেনেই পার্থবাবু কি শোভনকে সক্রিয় হতে বলছেন?’’ ফিরহাদকে তৃণমূলের অনেকেই পছন্দ করছেন না এবং আবার তাঁকে মেয়র পদে দেখতে তৃণমূলের অনেকেই চান না, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও সেই গোত্রেই পড়েন— সরাসরি না বললেও জয়প্রকাশের ইঙ্গিত সে রকমই।

এই জল্পনা যদি সত্যি হয়, তা হলে কিন্তু আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ফিরহাদের নামে ব্যানার দলের অনুমোদন নিয়ে ছাপানো হয়নি। শোভনের ব্যানার দেখে ফিরহাদ ‘টেনশনে’ আছেন, এমন মন্তব্য রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ করেছিলেন গতকাল। তা হলে কি সেই ‘টেনশন’ থেকেই বিচলিত হয়ে ফিরহাদ অনুগামীরা তড়িঘড়ি পাল্টা ব্যানার ছাপাতে শুরু করলেন? প্রশ্ন কলকাতা রাজনৈতিক শিবিরে। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই নতুন ব্যানার নিয়ে কটাক্ষ ছুড়েছেন ফিরহাদের দিকে। তিনি বলেছেন, ‘‘ফিরহাদ হাকিমের কাছে এ রকম একটা জাদুদণ্ড আছে জেনে আমি খুব খুশি হলাম। যে কাজ আগের মেয়র সাড়ে আট বছরে করতে পারেননি, সেই কাজ ফিরহাদ এক বছরে করে দিয়েছেন, এটা তো খুব খুশির খবর। কলকাতাবাসী হিসাবে খুব আশ্বস্ত বোধ করছি যে, আমাদের বর্তমান মেয়র এতখানি দক্ষ। ভবিষ্যতের জন্যও তাঁকে আমার শুভেচ্ছা রইল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE