সেই ১৯৭৩ থেকে এ পাড়ায় বাস। ক্যানিং স্ট্রিট সংলগ্ন পাড়াটা তখন ছিল অন্যরকম। দোকানপাট, যানজট, ভিড় সবই ছিল। তবে তুলনায় অনেকটা কম।
আজ ব্যবসার ভিড়ে হারানো একটা পাড়া। হাজারো নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত ক্যানিং স্ট্রিট, কলুটোলা এবং রবীন্দ্র সরণির নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন এই অঞ্চলটা।
দিনে দিনে পাড়াটা হয়ে উঠেছে ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র। মেহতা বিল্ডিং, বাগরি মার্কেট এখন এ পাড়ার ল্যান্ডমার্ক। শুধুই দোকান, বহুতল, যানজট আর ক্লান্তিহীন বেচাকেনা। নিশুতি রাতে এই পাড়াটাকে চেনা যায়।
তার মধ্যে একটা গলি এঁকে বেঁকে খানিকটা ঘুরে মসজিদের পাশে এসে মিশেছে। সেখানেই আমার বাড়ি। বর্ষায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি যেন অজস্র মুক্তোর মতো মসজিদের গম্বুজের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জানালা খুললে চোখে পড়ে চিৎপুরের নবাবদের লাল রঙের বাড়িটা।
এখন জোরালো আলো বসেছে, মিটেছে জলের সমস্যাও। নিয়ম করে জঞ্জালও পরিষ্কার হয়। কাউন্সিলর সুনীতা ঝাওয়ার খবর রাখেন, সমস্যার কথা শোনেন, সমাধানের চেষ্টাও করেন। যদিও সমস্যা অনেক। গলির দু’পাশে দোকান থাকায় আর সেখানে ইতস্তত ঠেলাগাড়ি-ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকায় ভিতরে গাড়ি ঢুকতে পারে না। গাড়ি রাখারও বেজায় সমস্যা। এমনকী আমাদের গলিতে অ্যাম্বুল্যান্সও ঢুকতে পারে না। ছ’বছর ধরে সপ্তাহে দু’দিন ডায়ালিসিস নিতে যেতে হয়। এতটা হেঁটে গাড়িতে ওঠা বড় কষ্টের। কিন্তু উপায়ও নেই!
এ পাড়ায় রাস্তার পাশে ফুটপাথও হকারদের দখলে। হাঁটাচলার আর এক নাম তাই যন্ত্রণা! দ্রুত হাঁটলে মানুষে-ঠেলা গাড়িতে, ভ্যান-রিকশায় ধাক্কা লাগে। ব্যস ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। ক্ষণিকে মিটেও যায়। কান্না-হাসি, রাগ-অভিমান মেশানো অদ্ভুত এই বাজারি পাড়ায় সবই চলে দু’মুঠো অন্নের জন্য।
এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কখনও এই পাড়া বা এই অঞ্চলটা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি। কারণ, একে অপরের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ নিবিড় সম্পর্ক। প্রতিবেশীদের মধ্যেও রয়েছে সহমর্মিতা। কোনও সমস্যা হয়েছে শুনলে তাঁরা ছুটে আসেন, সাহায্যও করেন, সুখে দুঃখে পাশে থাকেন। এ পাড়ার ইদ, মহরম ইত্যাদি পরব দেখার মতোই। আরও একটা জিনিস দেখার মতো— বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও একে অন্যের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি।
আমাদের পাড়ার পাশেই চিৎপুর রোডের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আতরের দোকান, মোরাদাবাদী পিতলের বাসনের দোকান, কুর্তা-পাজামার দোকান, জুতোর দোকান, চামরের দোকান কিংবা সেকেলে হুক্কার দোকান। তেমনই এ পাড়ার রসনার হাতছানিকেও উপেক্ষা করাও মুশকিল! রয়্যালের বিরিয়ানি-চাঁপ থেকে শুরু করে জিভে জল আনা নানা ধরনের অনবদ্য কাবাব। আর আদম কাবাবওয়ালার সেই বিখ্যাত সুতা কাবাবের আকর্ষণে আজও ভিড় করেন বহু মানুষ। তেমনই মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ এখানকার মসকাট কা হালুয়া, কিংবা আফলাতুন এক বার খেলে আবারও খেতে হবে।
এ পাড়া নিয়ে আমার গর্বও আছে, আক্ষেপও আছে। এলাকাটির অবস্থানগত কারণেই হোক বা লোকসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণেই হোক, এখানে একটুকরো ফাঁকা জায়গা নেই। ছোটদের কোনও খেলার মাঠও নেই। গাছগাছালিও বেশ কম। ছুটির দিনে যখন বাজারটা বন্ধ থাকে এই বাজারি পাড়ার অন্য চেহারা চোখে পড়ে। আজও এ পাড়ায় ছোটরা মাঝে মধ্যেই ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়। ঘুড়ি ওড়ানোর সেই ঐতিহ্যটা এখানে আজও টিকে।
অসুবিধের পাশাপাশি এ পাড়ায় থাকার কিছু সুবিধেও আছে। যে কোনও জিনিস হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। তেমনই প্রয়োজন হলে হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রায় রোজই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতাম আমার কর্মস্থল অল ইন্ডিয়া রেডিওয়।
অন্যান্য পাড়ার মতো শান্ত নিরিবিলি পরিবেশটা এখানে নেই। কলকাতার অনেক পাড়ার মতো আড্ডার সেই পরিবেশটা না থাকলেও এ পাড়ার অভিজাত মুসলিম পরিবারগুলিতে আজও মেহফিলের সেই ঐতিহ্যটা রয়ে গিয়েছে। সেখানেই সকলে মিলিত হয়ে গান-বাজনা, গল্পগুজব করেন। মনে পড়ছে আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েক বার এমনই মেহফিলে এসেছিলেন বিসমিল্লা খান। সম্পর্কে তিনি আমার মামা হতেন। আর আসতেন মুনওয়র আলি খান। এ পাড়া নিয়ে রয়েছে এমন কতও স্মৃতি।
ছ’পুরুষ আমরা কলকাতায় আছি। ছেলেবেলাটা কেটেছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। দু’বার বাসস্থান পরিবর্তন করে এখানে। জীবনের এতগুলো বছর সুখে দুঃখে যে পাড়ায় থেকেছি তার প্রতি একটা আত্মিক টান অনুভব করি। এ পাড়ারও একটা চরিত্র আছে, গন্ধ আছে। আমার জীবনের সঙ্গে সেটা একাত্ম হয়ে গিয়েছে।
লেখক বিশিষ্ট সানাইবাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy