Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
স্বঘোষিত দাদাদের দৌরাত্ম্যে ত্রস্ত শহরবাসী, প্রতিকার কি মিলবে?
Coronavirus

ফুটপাতে এখন চলছে ‘করোনা রেট’

সূত্রের খবর, লকডাউনের পরে দাদাদের বাড়তি আয়ের আশা গড়িয়াহাট, গোলপার্ক, যাদবপুর, হাতিবাগান, উল্টোডাঙা, শ্যামবাজার, বড়বাজারের ফুটপাত ঘিরে।

অসহায়: দীর্ঘ লকডাউনের পরে দোকান খুললেও ব্যবসায়ীরা জুলুমের মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ। শনিবার, গড়িয়াহাটে। ছবি: সুমন বল্লভ

অসহায়: দীর্ঘ লকডাউনের পরে দোকান খুললেও ব্যবসায়ীরা জুলুমের মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ। শনিবার, গড়িয়াহাটে। ছবি: সুমন বল্লভ

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২০ ০১:৪১
Share: Save:

“তোমার তো ভালই বিক্রিবাটা হচ্ছে এখন, পুরনো রেটে আর ক’দিন?”

আনলক-১ পর্বে সব খোলার কয়েক দিনের মধ্যেই ভবানীপুরের ফুটপাতের এক হকারকে ডেকে প্রশ্নটা করেছিলেন পাড়ার দাদা। অভিযোগ, ওই দাদা বলেন— “ছ’ফুট বাই আট ফুটের দোকান ২০১৭ সালে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে নিয়েছিলে। আর কিছুই দাওনি।” ওই হকার বলার চেষ্টা করেন, প্রতি সপ্তাহে যে ৩০০ টাকা দেন! কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দাদার মন্তব্য, “করোনার পরে পরিস্থিতি খারাপ। টাকা বাড়াতে হবে। আট ফুট জায়গার খানিকটা ছাড়তেও হবে। নতুন ছেলেরা দোকান দেবে।”

দোকান পাওয়া নতুনদের এক জন আবার বলছেন, “লকডাউনে গাড়ি চালানোর কাজ হারিয়েছি। দেখলাম, ফ্ল্যাটের চেয়েও ফুটপাতের দাম বেশি। ছ’ফুট বাই ১০ ফুট জায়গার জন্য তিন লক্ষ টাকা দিতে হল। প্রতি বর্গফুট পাঁচ হাজার করে!”

আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে শোরগোল চলছে জেলায় জেলায়। এর আগে যা দেখা গিয়েছিল শাসক দলের নেতাদের কাটমানি নেওয়ার অভিযোগে। সেই সময়ের মতোই এ শহরেও নেতা-দাদাদের পুরনো দাপট ফিরে এসেছে বলে অভিযোগ। আর এখন ফুটপাত ব্যবসা নিয়েই দাদাগিরি বেশি চলছে বলে দাবি। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেই নেতা-মন্ত্রীরা ফুটপাতের হকারদের সরানোর কথা বললেও আদতে কিছুই হয় না। পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বরং ফুটপাতে পরপর দোকান তৈরি হয়ে যায়।

ফুটপাতের করোনা রেট*

এলাকা এককালীন (প্রতি বর্গফুট) সাপ্তাহিক
আগে এখন আগে এখন
• গড়িয়াহাট ৪৫০০ ৬৫০০ ৩০০ ৩৫০
• ভবানীপুর ৪০০০ ৫০০০ ২০০ ৩০০
• হাতিবাগান ৪৫০০ ৫৫০০ ২০০ ২৫০
• শ্যামবাজার ৩৫০০ ৫০০০ ১৫০ ২০০
• গোলপার্ক ৪০০০ ৫০০০ ১৫০ ২০০
• উল্টোডাঙা ৩০০০ ৪০০০ ১০০ ২০০
*টাকায় (দরের হেরফেরও হয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে)

সূত্রের খবর, লকডাউনের পরে দাদাদের বাড়তি আয়ের আশা গড়িয়াহাট, গোলপার্ক, যাদবপুর, হাতিবাগান, উল্টোডাঙা, শ্যামবাজার, বড়বাজারের ফুটপাত ঘিরে। কারণ এখানে দর সবচেয়ে বেশি। সব জায়গাতেই চলছে ‘করোনা রেট’। সেখানে ব্যবসা করতে আগে যা টাকা দিতে হত, এখন দিতে হচ্ছে প্রায় তিন গুণ।

বড়বাজার এবং গড়িয়াহাট বাজারের ফুটপাতে এত দিন ‘প্যাকেজ সিস্টেম’ চালু ছিল বলে জানাচ্ছেন হকারেরা। সেই ‘প্যাকেজ’-এ স্টলের জন্য আলো-পাখার বন্দোবস্ত ছিল। বসার টুল এবং টেবিলের জন্যেও আলাদা করে ভাড়া গুণতে হত না। কিন্তু দাদারা বিনা মূল্যে এখন আর কিছুই হবে না বলে দিয়েছেন। স্টলপিছু ‘তোলা’র পরিমাণও সপ্তাহে ৫০ টাকা করে বেড়েছে!

উত্তর কলকাতার বাগবাজার, রবীন্দ্র সরণি, অরবিন্দ সরণি, মানিকতলা, ও নারকেলডাঙা এলাকায় আবার হকারদের থেকে টাকার পাশাপাশি মিটিং-মিছিলের মিষ্টি, জলখাবারও চাওয়া হত এত দিন। সেখানকার এক হকার বললেন, “দাদারা বলে দিয়েছেন, মিটিং-মিছিল হবে না এখন, তাই জলখাবারের টাকা নগদেই দিতে হবে।”

উত্তরের খন্না মোড়ে আবার শুরু হয়েছে স্টল ভাগাভাগি। গত লোকসভা ভোটের আগে খন্না মোড় থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত ফুটপাতে কিছু নতুন লোহার স্টল তৈরি করিয়ে তাতে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ছবি লাগানো হয়েছিল। অভিযোগ, হকারদের থেকে সেইসব স্টল পিছু নেওয়া হয়েছিল চার-পাঁচ লক্ষ টাকা করে। গত সপ্তাহে ওই হকারদেরই বলা হয়েছে, সকালে যিনি ব্যবসা করবেন, বিকেলে তিনি বসতে পারবেন না। বিকেলে বসবেন অন্য ব্যবসায়ী। সজল প্রামাণিক নামে এক হকারের কথায়, “বলা হচ্ছে, বেশি ছেলের উপকারের জন্য এই সিদ্ধান্ত। আসলে সবটাই টাকা কামানোর খেলা। একই স্টলে অন্য লোককে বিকেলে বসিয়ে তাঁদের থেকেও টাকা তুলবে।”

উল্টোডাঙা মেন রোডের তৃণমূল পরিচালিত হকার্স ইউনিয়নের নেতা রবি পাল বললেন, “কারা টাকা খাচ্ছে বলতে পারব না। নতুন অনেক দাদা গজিয়ে উঠেছে, তারা বলতে পারবে।” পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিমকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তিনি মেসেজেরও উত্তর দেননি। তবে প্রশাসকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য তথা তৃণমূল নেতা অতীন ঘোষ বললেন, “টাকা যাঁরা চান, তাঁরা নিশ্চয়ই পুরসভার লোক নন। অভিযোগ করার বহু জায়গা রয়েছে, সেখানে কেউ অভিযোগ করলে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গড়িয়াহাট হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নিমাই সরকারের অবশ্য দাবি, “তোলার টাকা হাত ঘুরে কত দূর যায়, আমরা জানি না। কার কাছে অভিযোগ করব? মুখ খুললেই তো মেরে দোকান তুলে দেবে।”

চলবে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Coronavirus Lockdown Footpath Hawkers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE