স্মৃতিময়: চিড়িয়াখানার ভিতরে এই পাঠাগারেই রয়েছে বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত বই এবং নথি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
১৯৯৬ সালের পয়লা জানুয়ারির কথা আজও ভুলতে পারেন না শিউপূজন। সবে ভবানীপুর থেকে বাঘের ছানা অনির্বাণকে এক্স-রে করিয়ে এনেছেন। এমন সময় কানে এল খবরটা। বাঘিনি শিবার ঘেরাটোপে ঢুকে পড়েছেন দু’ জন। কোনও মতে অনির্বাণকে খাঁচায় রেখে ছুটেছিলেন সে দিকে। শিবার কাম়ড়ে রক্তাক্ত লোকটাকে উদ্ধার করে ছুটেও ছিলেন পি জি হাসপাতালে। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি।
তার পাঁচ বছর পরে ফের একই ঘটনা। সে বার জোয়ান লোকটা ঢুকে পড়েছিল শিবার ছেলে ববের খাঁচায়। মায়ের মতো ছেলেও রেয়াত করেনি উটকো লোকটাকে। ষোলো বছর আগের সেই ঘটনা মনে করে প্রবীণ কিপার বিড়বিড় করেন, ‘‘নিজেকে মরদ প্রমাণে কী যে তাগিদ ছিল লোকটার!’’
শীতকালে শহুরে বিনোদনের জায়গা চিড়িয়াখানা। কিন্তু আলিপুর রোডের এই জমিতে রয়েছে নানা গল্প, ইতিহাসের টুকরো ছবি। এই চিড়িয়াখানা তৈরি হওয়াই তো ঘটনাবহুল! ১৮৪২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালার কিউরেটর জন ম্যাকক্লেল্যান্ড চিড়িয়াখানা তৈরির পরিকল্পনা করেন। তেমন সা়ড়া মিলল না। ১৮৬৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ বার্ট ফেয়েরার দায়িত্ব নিলেন, এ বার জমি মিলল না। ১৮৭৩ সালে ফের নতুন পরিকল্পনা করলেন তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল কার্ল লুইস শেন্ডলার। জমির অভাবে হিমঘরে গেল তা-ও। অবশেষে ১৮৭৫ সালে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর রিচার্ড টেম্পল কমিটি তৈরি করে জমি ঠিক করলেন, জিরাট ব্রিজ থেকে বেলভেডিয়ার রোডের মধ্যে আলিপুর রোডের দু’ দিকে তৈরি হবে চিড়িয়াখানা। প্রথম দফায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে আলিপুর রোডের পশ্চিম দিকে তৈরি হল পশুপাখির শহুরে আবাস। অনেকের সঙ্গে কাজে যোগ দিলেন মুর্শিদাবাদের লালগোলা থেকে আসা যুবক রামব্রহ্ম সান্যাল। তিন বছর পরে তিনিই হবেন প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট। পরে লিখবেন, বন্দি অবস্থায় পশুপাখিদের জীবন নিয়ে বিশ্ববন্দিত বই।
এর পরেও কম বদল আসেনি এই ‘চিড়িয়াঘর’-এ! খাঁচার চেহারা থেকে হাসপাতাল, বারবার বদলেছে সে সব। প্রায় চার যুগ ধরে চিড়িয়াখানায় জুড়ে থাকা শিউপূজন বলতে থাকেন, ‘‘আদিগঙ্গার পাড়ে হাসপাতাল ছিল। নাম ছিল জয়গোবিন্দ লাহা ল্যাবরেটরি। সেখানে তো বিরাট হোটেল হল। সরে এল হাসপাতাল।’’ তবে চিড়িয়াখানার অন্দরে এখনও রয়ে গিয়েছে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নামাঙ্কিত বাড়িটি। বিরাট লাইব্রেরি, মাঝে গোল টেবিলে বসতেন চিড়িয়াখানার ম্যানেজিং কমিটির সদস্যেরা। পশুপাখিরা এখন অবশ্য রাজ্য জ্যু অথরিটির অধীন। কিন্তু রয়ে গিয়েছে গোল টেবিল, আলমারিতে সাজানো চার্লস ডারউইন, লন্ডন জ্যুলজিকাল সোসাইটি, বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রির দুষ্প্রাপ্য সব বই। সে সবের মাঝে বসে এখন পরিযায়ী পাখি নিয়ে গবেষণা করেন বাঙালি যুবক ঋক চক্রবর্তী।
এই চিড়িয়াখানায় ইতিহাস হয়ে রয়েছে জেনির বন্ধুত্ব। পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে ১৮৭৬ সালে আলিপুরে এসেছিল এই মাদি ওরাং-ওটাং। বন্ধুর মৃত্যুর পরে তার সখ্য গড়ে ওঠে একটি বেড়ালের সঙ্গে। দুই ভিন্ন জাতের অবোলার নাওয়া-খাওয়া-দুষ্টুমির গল্প চিড়িয়াখানার দেওয়ালে গাঁথা। ১৮৭৮-এ বিলেত যাওয়ার সময়ে জেনির সঙ্গী হয় বেড়ালটিও।
সে বছরই চিড়িয়াখানায় এসেছিল দুই মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল। পশুশালার দেওয়াল বলছে, ১৮৮০-তে তিন ছানাকে নিয়ে সংসার ভরে ওঠে তাদের।
জেনি এবং ওই মানুষখেকোদের সমসাময়িক ‘অদ্বৈত’ কিন্তু এখনও বাঙালির মনে। রবার্ট ক্লাইভ উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন তাকে। ১৮৭৬ সাল ব্যারাকপুর থেকে ঠাঁই বদলে আলিপুরে আসা এই গজকচ্ছপের খুনসুটিও পুরনো কিপারদের মনে রয়েছে। ‘‘বাব্বা, শীতকালে উনি কিছুটি মুখে দেবেন না। কত কাণ্ড করে খাওয়াতে হত!’’ বলে চলেন চিড়িয়াখানার প্রবীণতম মানুষটি। ২০০৬ সালে মারা যাওয়ার পরে আলিপুরেই সমাহিত হয় অ্যাল়ডেবরা প্রজাতির ওই কচ্ছপ। চিড়িয়াখানার অন্দরে পরকালও কাটায় প্রাণীরা।
এই তো সে দিন বুড়ো বয়সে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেল সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল সুন্দরকান্ত। লোকচক্ষুর আড়ালে চিড়িয়াখানায় কবর দেওয়া হয়েছে তাকে।
শহরের মধ্যে এ-ও এক অন্য শহর! যেখানে জন্ম আছে, আছে মৃত্যু। সেখানে বৃদ্ধের ফেলে যাওয়া জায়গা পূরণ করে নবজাতক। খাঁচার ঘেরাটোপে মানুষ ও না-মানুষে গড়ে ওঠে মায়ার বাঁধন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy