নির্দিষ্ট রুট আছে। কিন্তু সেই রুট মেনে এ শহরের অটো চলবে কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই! তাই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ থেকে বেহালা যাওয়ার অটোয় উঠলে হয়তো নেমে যেতে হবে তারাতলায়। সেখান থেকে ধরতে হবে অন্য কোনও অটো! চালকের ইচ্ছে হলে ফুলবাগান থেকে মেছুয়ার অটো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে কলেজ স্ট্রিট থেকে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অটোচালকদের এমন দৌরাত্ম্য ঘিরেই আক্রান্ত হয়েছেন এক কলেজছাত্রী ও তাঁর বাবা। তার পরে বুধবারও দিনভর শহরে ঘুরে নজরে এসেছে চালকদের ইচ্ছেমতো রুট তৈরি। চলতি ভাষায় যাকে ‘কাটা রুট’ বলেন অটোচালক ও নিত্যযাত্রীরা। এ দিন দুপুরে দেখা গেল, হাজরা-বেহালা রুটের অনেক অটোই মাঝপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিউ আলিপুর সি ব্লকের কাছে। সেখান থেকে ফের যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে হাজরার দিকে। একই অবস্থা রাসবিহারী থেকে বেহালা চৌরাস্তা যাওয়ার অটোরও। বেশির ভাগই তারাতলা থেকে ফের ফিরে আসছে রাসবিহারীতে।
উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার আরও অনেক রুটেই এমন নমুনা মিলবে। ফুলবাগানের এক বাসিন্দা উঠেছিলেন মেছুয়ার অটোয়। আমহার্স্ট স্ট্রিট ও কেশব সেন স্ট্রিটের মোড়ে বাকি যাত্রীরা নেমে গেলে কলেজ স্ট্রিট বাটার সামনে পৌঁছে চালক জানান, অটো আর যাবে না। মে মাসের দুপুরে সেখানেই কার্যত জোর করে ওই ব্যক্তিকে নামিয়ে দেন চালক। ফের যাত্রী তুলে ফিরে যান ফুলবাগানের দিকে। বিকেলে হাজরা থেকে কসবা যাওয়ার কয়েকটি অটো বিজন সেতু পৌঁছে ফের যাত্রী তুলে রওনা দেয় উল্টো মুখে। এক সময়ে শোভাবাজার হাটখোলা থেকে উল্টোডাঙা এবং আহিরিটোলা ঘাট থেকে উল্টোডাঙা রুটে অটো চলত। কিন্তু উল্টোডাঙা থেকে বেশির ভাগ অটোই এখন শোভাবাজার মেট্রো পর্যন্ত চলে। হাটখোলা বা আহিরিটোলা যেতে সেখান থেকে ধরতে হবে রুট ভেঙে তৈরি হওয়া নতুন রুটের অটো।
কেন এমন করেন অটোচালকেরা?
শহরের বিভিন্ন রুটের চালকদের বক্তব্য— লম্বা রুটে টানা অটো চালালে একলপ্তে ভাড়া যতটা হয়, রুট ভেঙে চালালে তুলনায় অনেক বেশি লাভ হয়। তার উপরে অনেক সময়েই লম্বা রুটের শেষ পর্যন্ত যাত্রী থাকে না। তার ফলে খালি অটো নিয়ে যেতে জ্বালানি খরচ হয়। তাই তাঁরা মাঝপথ থেকে ফিরতি পথের যাত্রী তোলেন বলে দাবি অটোচালকদের। তাঁরা আরও বলছেন, একে জ্বালানির দাম, তার উপরে পুলিশি জুলুমে আয়ের অনেকটা চলে যায়। সেই ঘাটতি পূরণেও ভরসা কাটা রুট। চালকদের একাংশ বলছেন, পুরো রুটে গেলে লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলতে হবে। তাতে অনেক কম ‘ট্রিপ’ খাটা যাবে। এক চালকের কথায়, ‘‘অটোর মালিককে দিনের শেষে নির্দিষ্ট টাকা দিতে হয়। কম ট্রিপ হলে মালিককে টাকা দিয়ে আমার কিছুই থাকবে না।’’
কিন্তু রুট লাভজনক না হলে যাত্রীরা কেন হেনস্থার শিকার হবেন? কেনই বা সে ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেবে না?
দক্ষিণ কলকাতা অটোচালক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিতান হালদার বলছেন, ‘‘কিছু চালক রুট ভেঙে চালান। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে আমরা এর বিরুদ্ধে সব সময়ে সক্রিয়।’’ তৃণমূলের শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক কারণেই অনেক সময়ে চালকেরা রুট ভেঙে নেন। কিন্তু যতটা রুটের পারমিট আছে, ততটাই চালাতে হবে।’’
বছর দুয়েক আগে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও ঘোষণা করেছিলেন, সব অটোচালককেই নির্দিষ্ট রুটে চলতে হবে। তার পরেই বিভিন্ন জায়গায় অটোর রুট নিয়ন্ত্রণে নামে পুলিশ। কিন্তু দিন কয়েক পরেই তা বন্ধ যায়। পরিবহণ কর্তারাই বলছেন, ওই ক’দিন নিয়ম মানলেও ফের অটো ফিরে গিয়েছে ‘নিজের নিয়মে’। কিন্তু তাঁরা কিছু বলছেন না কেন? দফতরের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, ‘‘আমরা অটোর রুট পারমিট দিই। কিন্তু তা দেখভাল করার দায়িত্ব পুলিশের।’’ যদিও লালবাজারের ট্রাফিক কর্তারা বলছেন, পরিবহণ দফতরেরও ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার রয়েছে। ‘‘তা না হলে মোটর ভেহিক্লস ইনস্পেক্টরা রয়েছেন কেন!’’ মন্তব্য এক পুলিশকর্তার। লালবাজার সূত্রের বক্তব্য, অটোর বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বটে। কিন্তু কাটা রুটের মতো শহরব্যাপী অনিয়মে সে ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই এতে রাজনৈতিক মদত থাকে। তাই আগ বাড়িয়ে ঝামেলা চান না পুলিশকর্মীরা।
তবে বেপরোয়া অটোর বিরুদ্ধেও সে ভাবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ। বুধবারও যাদবপুর ও সল্টলেকে দু’টি অটো দুর্ঘটনায় এক বালক ও তিন মহিলা আহত হন। পুলিশ জানায়, সকাল পৌনে ১১টা নাগাদ যাদবপুরের রাজা এস সি মল্লিক রোডে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি উল্টে যায়। অটোয় চালক শম্ভু সাঁইয়ের সঙ্গে ছিল তার ছেলে তমাল (১২)। আহত অবস্থায় ওই বালক একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। বিকেল ৪টে নাগাদ বৈশাখী মোড় থেকে ৮ নম্বর ট্যাঙ্কের দিকে যাওয়ার পথে অটো উল্টে জখম হন তিন মহিলা। বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy