Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

রিপোর্ট তলবে কোপ স্বশাসনেই

এক এক বার একটা একটা ঘটনা ঘটে। আর প্রতি বারই বলি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন! পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে এখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দস্তুর! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাও সেই তালিকায় নাম তুলল। বুধবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার পরেই উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের কাছে রিপোর্ট তলব করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

এক এক বার একটা একটা ঘটনা ঘটে। আর প্রতি বারই বলি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন! পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে এখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দস্তুর! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাও সেই তালিকায় নাম তুলল।

বুধবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার পরেই উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের কাছে রিপোর্ট তলব করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার সেই রিপোর্ট বিকাশ ভবনে গিয়ে জমাও দিয়েছেন উপাচার্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাঁর শীর্ষ পদে রয়েছেন খোদ আচার্য তথা রাজ্যপাল। তিনি উপাচার্যের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত বিষয়ে রিপোর্ট তলব করতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রী কেন উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট চাইবেন? আর উপাচার্যই বা কেন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দিয়ে আসবেন? এ তো সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ!

সুরঞ্জনবাবুর বক্তব্য, ঘটনার পরেই আচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আচার্য তথা রাজ্যপাল কলকাতায় ছিলেন না। এর পরে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই উপাচার্যের কাছ থেকে ঘটনা জানতে চান। একটি রিপোর্টও চেয়ে পাঠান। মন্ত্রীর মর্যাদা রাখতেই রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সুরঞ্জনবাবুর মতে, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার ভঙ্গ হয়নি। এটা সৌজন্য হিসেবেই দেখা উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘‘আচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছি। তাঁর কাছেও একই রিপোর্ট পাঠাব।’’

শিক্ষামন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে শুক্রবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যুক্ত মঞ্চের সদস্যেরাও। তাতে ফের স্পষ্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ গোটা বিষয়টিই এখন দেখভাল করছেন শিক্ষামন্ত্রী! সেনেট হলে আক্রান্ত শিক্ষক তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের (কুটা) সাধারণ সম্পাদক দিব্যেন্দু পালের বক্তব্য, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরকার বা শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আমরা চাইনি। তাই প্রথমেই সিন্ডিকেটের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু সিন্ডিকেট সমস্যা মেটায়নি।’’ তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে গেলেন কেন? দিব্যেন্দুবাবু বলছেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী দেখা করতে চেয়েছিলেন। তাই সৌজন্যের খাতিরেই গিয়েছিলাম।’’

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন

শিক্ষামন্ত্রীর নিজের যুক্তি অবশ্য চাঁছাছোলা! কিছু দিন যাবৎই তিনি বলে আসছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার যখন অর্থসাহায্য করে, সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও তাদের আছে! এ বারেও পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘এত বড়় একটা ঘটনা ঘটলে সেখানে সরকার তো হস্তক্ষেপ করবেই! রাজ্য সরকার তো ওই সব প্রতিষ্ঠানে টাকা দেয়।’’ সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেছেন, দুর্নীতি ধরতে প্রয়োজনে তাঁরা প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ অডিট করানোর কথা ভাবছেন। এরই পাশাপাশি সে দিনের ঘটনায় অভিযোগের তির যে ছাত্রদের দিকে, তাদের প্রতিই সহমর্মিতার বার্তা দিয়ে পার্থবাবুর মন্তব্য, ‘‘ছাত্রেরা আমার কাছে এসেছিল ভাঙা হাত নিয়ে। কই সে কথা তো কেউ বলছে না!’’ অথচ আক্রান্ত শিক্ষক দিব্যেন্দুবাবুর প্রতি

এমন সহানুভূতি দেখাননি শিক্ষামন্ত্রী। বরং বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে! যা শুনে দিব্যেন্দুবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘হয়তো আমার মৃতদেহ দেখলে উনি খুশি হতেন!’’

গোটা ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার, শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে! শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই বক্তব্য, রোগ আসলে অনেক গভীরে। খাতায়-কলমে শিক্ষা প্রশাসনের স্বশাসন রেখেও পার্থবাবুর জমানায় যে ভাবে তার টুঁটি টিপে ধরা হয়েছে, তাতে এমন ঘটনাই স্বাভাবিক। অথচ শিক্ষার অঙ্গনকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করতে চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কিছু সংস্কারের পথে সত্যিই হাঁটতে চেয়েছিল। বস্তুত ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার যে আইন করেছিল, তারই সংস্কার করা হয়েছিল ২০১২ সালে। তার অন্যতম প্রতিপাদ্য ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের মতো জায়গায় পড়াশোনার বিষয় ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও বক্তব্য থাকতে পারবে না। অন্য রকম দাবি-দাওয়া, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সেনেটে আলোচনা করা যাবে না। কোনও শিক্ষক বা অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ুয়ারা সেনেটে বা এই ধরনের কোনও ‘বডি’-তে আনতে পারবেন না। লিংডো কমিশনের সুপারিশ মেনে সরকার এটাও কার্যকর করতে চেয়েছিল যে, প্রতিদ্বন্দ্বী পড়ুয়াদের কেউই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, ছাত্র পরিষদ, এসএফআই, এবিভিপি-র প্রার্থী হিসেবে এবং সেই সব সংগঠনের প্রতীক নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটে লড়তে পারবেন না। কিন্তু এ সব শেষ পর্যন্ত দিনের আলোর মুখ দেখেনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় আইন আরও সংশোধন করে উপাচার্য নিয়োগের সার্চ কমিটিতে ইউজিসি-র বদলে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। কালে কালে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী, নিজেই হয়ে বসেছেন উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানও!

অনিলায়নের গেরো থেকে শিক্ষাঙ্গনকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী এ সব মানলেন কেন? দলেরই এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘দিদিকে বোঝানো হয়েছিল, শিক্ষায় সংস্কার যে মহতী, সেই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ফলে আখেরে আমাদের পার্টিটাই উঠে যাবে!’’ দলনেত্রীকে বলা হয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম না করতে পারলে দলের মুঠি অনেক জায়গা থেকেই আলগা হয়ে যাবে। তার পরেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কারের চেষ্টা ব্রাত্য হয়ে যায় এবং শিক্ষার হাল ধরেন পার্থবাবু।

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ অধিকারীর সঙ্গে এ দিন বিকাশ ভবনেই বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। সৌরভের বিরুদ্ধেই শিক্ষক নিগ্রহে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও টিএমসিপির রাজ্য সভাপতি অশোকও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ধর্নায় বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের প্রশ্ন, অভিযুক্ত ছাত্রনেতা এবং সেই সংগঠনের শীর্ষ পদাধিকারীর সঙ্গে সরকারি দফতরে বসে কেন বৈঠক করবেন মন্ত্রী? পার্থবাবুর উত্তর, ‘‘আমি বিরোধী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও এখানে বৈঠক করি। এতে অসুবিধা কোথায়!’’

এই পরিস্থিতিতে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু দাবি করেছেন, এর পরে পার্থবাবুর আর শিক্ষামন্ত্রী থাকাই উচিত নয়। বিমানবাবুর বক্তব্য, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ শিক্ষাঙ্গনে যা চলছে, শিক্ষামন্ত্রী যদি তা না বন্ধ করতে না পারেন, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর বলা উচিত, আমি পারছি না।’’ বামফ্রন্টের বৈঠকে এ দিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে নিন্দা প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। উপাচার্য সুরঞ্জন দাসও বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তিনি পদত্যাগের কথা ভাববেন।

এমতাবস্থায় আক্ষেপ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারেন শিক্ষাবিদেরা? স্বাধিকার রক্ষার প্রসঙ্গেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডিসটিংগুইশড প্রফেসর’ স্বপন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধিকার বজায় রাখতে হলে ছাত্র-শিক্ষক-কর্তৃপক্ষ সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক নেতারা তো অধিকার হরণের সুযোগ পেয়েই যাবেন।’’ আবার আইআইএম-কলকাতার অধ্যাপক অনুপ সিংহর বক্তব্য, ‘‘আসল সমস্যাটা একটা বড় রাজনৈতিক সমস্যা। প্রায় প্রতি দিনই কোনও না কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত টিএমসিপি।’’ স্বশাসন-বিতর্কে সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে তৃণমূল সাংসদ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুগত বসু বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনকে শ্রদ্ধা জানিয়েই রাজ্যের সুনাম ধরে রাখতে সকলের সচেষ্ট হওয়া উচিত।’’ শিক্ষক নিগ্রহের নিন্দা করলেও তিনি সমালোচনা করেছেন তাঁদের ধর্না-অবস্থানেরও। তিনি বলছেন, ‘‘শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের ধর্না হওয়া উচিত নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE