নিশানা: রবার বুলেট ছুড়ে বাগড়ি মার্কেটের পাঁচতলার একটি ঘরের জানলার কাচ ভাঙার চেষ্টা করছেন কলকাতা পুলিশের কম্যান্ডো। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
চুরাশি ঘণ্টা পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এল ঠিকই। কিন্তু অগ্নিরহস্যের কিনারা যেমন হয়নি, ছাইচাপা আগুনও নেভেনি। ধোঁয়ার দাপটও অব্যাহত। দমকলকর্মীরা জানাচ্ছেন, বাগড়ি মার্কেটের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠতলে ভস্মস্তূপের কোথাও কোথাও রয়ে গিয়েছে আগুন। ক্রমাগত জল দিয়ে তা নেভানোর চেষ্টা চলছে। দগ্ধ ভবন এতটাই উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে যে, ফরেন্সিক বিভাগের কর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করতে পারেননি বুধবারেও।
দমকলের অন্যতম কর্তা দীপঙ্কর পাঠক বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা ওই বাড়ির সব জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন। আশা করা হচ্ছে, দু’দিনের মধ্যে এই ধোঁয়া পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে।’’
প্রায় চার দিনেও কেন ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না দমকল? কেনই বা এখনও রয়েছে ধিকিধিকি আগুন? দগ্ধ বাড়ির ভিতরে ঢোকা দমকলকর্মীরা জানান, ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকের কিছু অংশ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে আছে যে, জল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঝে থেকে ধোঁয়া উঠছে। ‘‘উত্তপ্ত কড়াইয়ে জল ঢাললে যেমন ধোঁয়া ওঠে, তেমনটাই হচ্ছে। হোসপাইপ দিয়ে ক্রমাগত জল দিয়ে মেঝে ঠান্ডা করতে হচ্ছে। নইলে ওখান থেকে ফের আগুন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে,’’ বলেন এক দমকলকর্মী। তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে বুধবার রাতের বৃষ্টি। বেশি রাতে দমকলের মাত্র দু’টি ইঞ্জিনে জল ঢালছিল।
ক্ষতির খতিয়ান
•ছ’তলা বাড়িটায় ৯৫৭টি ঘরের ৩০০র বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত। তবে বাগড়ি মার্কেটের গোটা বাড়িটা এখনও বন্ধ।
•ছ’তলা বাড়ির একতলায় এ থেকে এইচ— ৮টি ব্লক। একতলার প্রতি ব্লকে ৩৫টি করে দোকান। এর মধ্যে এইচ এবং জি ব্লক অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত। ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে ক্যানিং স্ট্রিটমুখী এ ব্লক।
• দু’তলা থেকে ছ’তলার এক-একটিতে চারটি করে ব্লক। প্রতিটি ব্লকে কম-বেশি ৪৫-৫০টি দোকান।
• বিভিন্ন দোকান মিলিয়ে ৬০০ জনের বেশি দোকান বা অফিস-মালিক। (কেউ কেউ একাধিক সংস্থার মালিক)
• বাগড়ি মার্কেট সেন্ট্রাল কলকাতা ট্রেডার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ৪৫০ জন। বাড়ির মালিকপক্ষ তথা ডিরেক্টররা নিজেরা কয়েকটি ঘর হাতে রেখেছেন। তাঁরা কয়েক জনকে ফের সেই ঘর ভাড়া দিয়েছেন। ওই ভাড়াটেরা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নন।
• ছ’তলা বাড়ির প্রতিটা অফিস-ঘরে গড়ে জনা পাঁচেক কর্মচারী। সব মিলিয়ে কম-বেশি ৫০০০ কর্মচারী রয়েছেন। তা ছাড়া আরও ৫০০০ মুটেও বাগড়ি মার্কেটের সঙ্গে জড়িয়ে।
(সূত্র বাগড়ির ব্যবসায়ীদের অ্যাসোসিয়েশন)
প্রতিটি ব্লকে ছোট ছোট খুপরি দোকানে কাঠের পার্টিশন। তার উপরে ফলস সিলিং। দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ পার্টিশন ভেঙে ভিতরে ঢোকেন দমকলকর্মীরা। ভিতরে দাহ্য বস্তুর ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যেই কোথাও কোথাও ঘাপটি মেরে আছে ছাইচাপা আগুন। দমকলের ভাষায় ‘পকেট ফায়ার’। দীপঙ্করবাবুর দাবি, ‘‘ছোট ছোট পকেট ফায়ারও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসছে।’’ ছাইচাপা আগুনের চোখরাঙানি ছাড়াও এ দিন বাড়তি তাপ ছড়ায় একটি গুজব। রটে যায়, মার্কেটের ভিতরে পেট্রল পাওয়া গিয়েছে। তার পরেই বিক্ষোভ শুরু করেন ব্যবসায়ীদের একাংশ।
পাশের মেহতা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে রবার বুলেট দিয়ে বাগড়ির পাঁচতলার জানলার কাচ ভাঙছিল কম্যান্ডো বাহিনী। ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে জল দেন দমকলকর্মীরা। ওই অংশে প্রচুর ধোঁয়া উঠতে শুরু করে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেটিরিয়ালের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সোমনাথ ঘোষ জানান, ওই ভবনের ধোঁয়া ও আগুন পুরোপুরি বন্ধ হলে প্রথমেই পুরো বাড়ির কংক্রিটের শক্তি পরীক্ষা করা দরকার। তার জন্য আল্ট্রাসোনিক পালস ভেলোসিটি টেস্ট করা যেতে পারে। কংক্রিটের ভিতরকার স্টিল পরীক্ষার জন্য ডিজিটাল স্ক্যানিং করা যেতে পারে। ‘‘এই সব পরীক্ষার ফলাফল দেখে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, ওই ভবন কতটা ব্যবহারযোগ্য আছে,’’ বলেন সোমনাথবাবু।
ওই ভবনের অপেক্ষাকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লকের ব্যবসায়ীদের বুধবারেও দিনভর জিনিসপত্র সরাতে দেখা যায়। ভবনের ছাদে উঠে দেখা যায়, সেখানে দারোয়ানদের আবাসনে ফিরে এসেছেন রামেশ্বর যাদব নামে এক রক্ষী। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার মাঝরাতে হইচই শুনে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, নীচে সকলেই পাগলের মতো দৌড়চ্ছে আর বলছে, ‘আগ লাগ গয়া, আগ লাগ গয়া। ভাগো।’ আমরা আতঙ্কে নীচে নেমে আসি।’’
রামেশ্বরের দাবি, তাঁরাও আগুন নেভাতে দমকলকে সাহায্য করেছেন। পরে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চলে যান এক আত্মীয়ের বাড়িতে। রামেশ্বর বলেন, ‘‘ফিরে এসেছি ঠিকই। কিন্তু এই কোয়ার্টারে এখন তো আর থাকা যাবে না। আলো নেই। জলও নেই। বিভিন্ন তলায় ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। তাই কিছু জামাকাপড় নিয়ে ফিরে যাব আত্মীয়ের বাড়িতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy