Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলবাসকেও রেহাই দিল  না বন্‌ধ-বীরদের বাহিনী

মিছিল থেকে বেরোনো ছেলেরা লাঠি উঁচিয়ে গালিগালাজ শুরু করতেই রণে ভঙ্গ দিলেন দোকানদারেরা। মুদির দোকান, ব্যান্ডপার্টির অফিস থেকে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার কারবারিরা কেউই সাহস দেখানোর সামান্য চেষ্টাও করলেন না।

নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:০৯
Share: Save:

শহরের নিস্তরঙ্গ মেজাজটা পাল্টে গেল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে মিছিলটা মহাত্মা গাঁধী রোডে ঢুকতেই আতঙ্কে দু’পাশের দোকানগুলিতে শাটার নামানো শুরু হল ঝটপট। মিছিল থেকে বেরোনো ছেলেরা লাঠি উঁচিয়ে গালিগালাজ শুরু করতেই রণে ভঙ্গ দিলেন দোকানদারেরা। মুদির দোকান, ব্যান্ডপার্টির অফিস থেকে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার কারবারিরা কেউই সাহস দেখানোর সামান্য চেষ্টাও করলেন না।
ইদানীং বন্‌ধের প্রভাব অনেকটাই কমে আসছে কলকাতায়। তবু বুধবারের ছবিটা কিছুটা অন্য রকম হয়েই থাকল। বলা ভাল, বন্‌ধের দিনের চিরকেলে ‘জুলুমবাজি’র ছবিটাই ফিরে এল শহরে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বাস, ট্যাক্সি ভাঙচুরের অভিযোগ মিলেছে। এমনকি, হাসপাতালমুখী রোগীর ট্যাক্সি বা স্কুলপড়ুয়াদের বাস— ‘ত্রাস’ থেকে রেহাই মেলেনি কারও। রাজারহাটের কালিকাপুরে দিল্লি পাবলিক স্কুল মেগাসিটি-র প্রধান শিক্ষিকা ইন্দ্রাণী সান্যালের তরফে অভিযোগ জমা পড়েছে বিমানবন্দর থানায়। তাতে বলা হয়েছে, সকাল ৭টা ১০ মিনিটে গঙ্গানগরের বি টি কলেজের কাছে স্কুলের কচিকাঁচায় বোঝাই একটি বাসকে ঘিরে ধরে টানা মিনিট পনেরো দৌরাত্ম্য চালায় বন্‌ধ-সমর্থকেরা। তাদের হাতে ছিল বাঁশ। যা দিয়ে বাসের গায়ে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে তারা। সেই আঘাতে চিড় ধরে যায় উইন্ডস্ক্রিনে। ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে থাকে ভিতরে বসে থাকা শিশুরা। কান্না জুড়ে দেয় অনেকে। বন্‌ধ-সমর্থক দুষ্কৃতীরা তাতে আরও উৎসাহ পেয়ে গিয়ে বাসটিকে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে শুরু করে। তখন শিক্ষকেরা করজোড়ে কাকুতি-মিনতি করে কোনওক্রমে রেহাই পান বলে প্রধান শিক্ষিকার চিঠিতে দাবি করা হয়েছে। স্কুলপড়ুয়াদের নিরাপত্তা নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আফশোসের পরেও এত বড় ঘটনা কী ভাবে ঘটে গেল, পুলিশ বা শাসক দলের স্থানীয় নেতা, কারও কাছেই তার সদুত্তর মেলেনি।
বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি এ বিষয়ে বলেন, ‘‘সিসি ক্যামেরায় ভাঙচুরের ছবি পাওয়া যায়নি। চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’’ অধ্যক্ষা যে লিখিত অভিযোগ করেছেন, তার ভিত্তি নিয়ে ওই পুলিশকর্তা শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে।’’
পরিবহণ দফতর ও পুলিশের দাবি, সকালের দিকে রোগী নিয়ে যাওয়ার সময়ে একটি ট্যাক্সি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছে। দুপুরে ব্রেবোর্ন রোডে ট্রাম কোম্পানির একটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। কাঁটাপুকুর এবং হাওড়ার মল্লিকফটকের কাছে রাজ্য পরিবহণ নিগমের দু’টি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়। লালবাজারের দাবি, এ দিন ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ৭২ জন বন্‌ধ-সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাশীপুর উদ্যানবাটী, হাজরা মোড়, বেহালা ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বিজেপি পার্টি অফিসের সামনে থেকে তাদের ধরা হয়। গড়িয়াহাট মোড়, হাজরা মোড়ে বিজেপি-র প্রথম সারির রাজ্য নেতারা পথে নেমেছিলেন। শহর জুড়ে বন্‌ধ ব্যর্থ করতে সেয়ানে-সেয়ানে লড়ে যান শাসক দলের নেতা-কর্মীরাও। তাতে আমজনতার আতঙ্ক পুরোপুরি দূর হয়নি। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকারের অবশ্য দাবি, ‘‘দু’-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া বন্‌ধ সমর্থকেরা তেমন গোলমাল পাকাতে পারেননি।’’
শহরের মধ্যে যানবাহন অবশ্য মোটের উপরে সচলই ছিল। কিন্তু দিনের বেশির ভাগ সময়েই শহর লাগোয়া রেললাইনের ‘দখল’ নিয়ে নেন বন্‌ধ-সমর্থকেরাই। ডায়মন্ড হারবারের একটি স্কুলে যাবেন বলে ভোর সাড়ে পাঁচটায় শিয়ালদহ স্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন এক দল স্কুলশিক্ষিকা। দেখা গেল, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বন‌্‌ধ-সমর্থকেরা ভোরের আগেই রেললাইনের ওভারহেড তারে কলাপাতা ফেলে গোটা পথ অগম্য করে রেখেছেন। ফলে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় সাড়ে সাতটার আগেই রেল চলাচল
কার্যত থমকে যায়। শিক্ষিকাদের
দলটি এর পরেও ট্রেনে বারুইপুরের বেশি দূর যেতে পারেননি। বারুইপুর স্টেশনে নেমে অটো, বাস ধরে সড়কপথে স্কুলে পৌঁছতে তাঁদের বেলা একটা বেজে যায়।
হাওড়া এবং শিয়ালদহে বিক্ষিপ্ত অবরোধ শুরু হয়েছিল সকাল থেকেই। শিয়ালদহ দক্ষিণে ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, ডায়মন্ড হারবার শাখায় অবরোধ হয়। তবে বজবজ শাখা স্বাভাবিক ছিল। বারাসত, মধ্যমগ্রাম, দত্তপুকুর, ইছাপুর, টিটাগড়েও সকালের দিকে অবরোধের ঘটনা ঘটে। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার নিত্যযাত্রী, ধর্মতলা এলাকার জনৈক সরকারি কর্মীর কথায়, ‘‘সরকার বন্‌ধের দিন অফিস যেতে বাধ্য করলে রাস্তায় নিরাপত্তার বন্দোবস্তও কিন্তু করা উচিত।’’ ফলতার এক কলেজশিক্ষকের দাবি, ‘‘বন্‌ধের দিনে বহু চেষ্টা করেও ভাড়া গাড়িকে যেতে রাজি করতে পারিনি। তবে রাস্তায় ভিড় কম থাকলেও বাস, অটো পেতে সমস্যা হয়নি।’’
দুপুরের দিকে বাস কমে গেলেও মেট্রো চালু ছিল বন্‌ধের শহরে। বড়বাজার, পোস্তার বেশির ভাগ দোকানই ছিল বন্ধ। শ্যামবাজার থেকে শখেরবাজার— বন্‌ধ সফল বা ব্যর্থ করতে সর্বত্রই দেখা গিয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের। হাতিবাগানের কাছে দেখা গেল, বিজেপি-র পিছনেই তৃণমূলের মিছিল। বাস চালানো থামাতে বা চালু রাখতে পরপর দু’পক্ষই হুমকি দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই বেশি লোক পথে নামেননি। দুপুরের দিকে শিয়ালদহের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যৎসামান্য ভিড়ে জনৈক ট্যাক্সিচালকের আফশোস, ‘‘গোটা দিনটাই মাঠে মারা গেল! অথচ না বেরোলেও বলবে, আমি নাকি বিজেপি হয়ে গিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bandh Vandalism Nuisance Trouble Inhuman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE