এমন জনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই চলছে ব্যাটারি কারখানা। নিজস্ব চিত্র
তার একটা নিজের নামও ছিল। তবে গত কয়েক দশকে সেই নাম প্রায় সকলেই ভুলে গিয়েছেন। কয়েক জন পুরনো বাসিন্দা ছাড়া বাকিরা জানেনই না, মানিকতলার ‘ব্যাটারি গলি’-র আসল নাম পেয়ারাবাগান। গলির মুখে পুরসভার লাগানো নামের বোর্ড রয়েছে। যদিও সেই বোর্ড বা পুরনো নামকে পাত্তা দেন না প্রায় কেউই।
বৃহস্পতিবার সে রকমই এক পুরনো বাড়ির বারান্দায় বসে এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘হঠাৎ করেই এই গলির দখল নিল ব্যাটারি কারবারিরা। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হত। শ্বাস নিতে পারতাম না। বড় ব্যবসা চলে এখানে। তাই কখনওই কেউ বাধা দেননি। অচিরেই এটা ব্যাটারি গলি হয়ে গেল!’’ অন্য এক বাসিন্দার ক্ষোভ, ‘‘এশিয়ার সেরা ব্যাটারি নাকি এখানে পাওয়া যায়। কিন্তু, পাড়ার মধ্যে এ রকম কারখানা থাকবে কেন? এই প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। এত দিনে যখন কিছু হয়নি, আর বলে কিছু হবে না।’’
শুধু পেয়ারাবাগানেই নয়, উত্তর কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় জনবসতির মধ্যেই রমরমিয়ে চলছে ব্যাটারির কারখানা— পরিবেশ দফতরের একাধিক নিষেধ এবং পরিবেশকর্মীদের শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও। গত বুধবার দুপুরেই পেয়ারাবাগানের বিপরীতে কারবালা ট্যাঙ্কের একটি ব্যাটারির কারখানায় আগুন লাগে। দমকলের তিনটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কেউ হতাহত না হলেও জনবসতি এলাকায় এ ভাবে ব্যাটারির কারখানা চালানো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ওই অগ্নিকাণ্ড। ওই কারখানার মালিক রাজেশপ্রসাদ জায়সবালের যুক্তি, ‘‘কারখানা অনেক পুরনো, আগুন লাগতেই পারে। বললেই তো কারখানা সরিয়ে নেওয়া যায় না!’’
একটি কারখানায় ডাঁই করা রয়েছে ব্যাটারি।
উত্তর কলকাতায় বিভিন্ন জনবসতি এলাকায় ব্যাটারির কারখানাগুলিতে ঘুরে দেখা গেল, কোথাও ব্যাটারির খোল ভাঙার কাজ চলছে, কোথাও সীসার পাত বানিয়ে লাগানো হচ্ছে ব্যাটারিতে। যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে নানা ক্ষতিকারক ধাতু ও অ্যাসিড। সেই অ্যাসিডের এমনই ঝাঁঝ যে, কারখানার ধারে কাছে ঘেঁষা যায় না।
কাঁকুড়গাছি পঞ্জাবি গ্যারাজ এলাকার একটি কারখানায় ব্যাটারির খোল ভাঙার কাজে ব্যস্ত এক কর্মী জানালেন, তাঁদের কারখানায় শুধুমাত্র পুরনো ব্যাটারির খোল ভেঙে ধাতব পদার্থ আলাদা করার কাজ হয়।
সেই ধাতব পদার্থ বিক্রি হয় কিলো দরে। বাকি পড়ে থাকা খোলও বিক্রি হয়। জল ভরার এবং গাছ লাগানোর কাজে ব্যবহার করতে তা কিনে নিয়ে যান অনেকে। তবে ব্যাটারি থেকে ধাতব পদার্থ বার করার সময়ে সুরক্ষা বিধি মানা হয় কি? কারখানার মালিক অজয় জায়সবাল বলেন, ‘‘ব্যবসাই চলছে না আর নিয়ম। কোথাও কোনও নিয়মের কথা লেখা নেই। অন্তত আমাদের কেউ বলতে আসেননি।’’
এই ধরনের ব্যাটারির কারখানা পরিবেশ দফতরের ‘রেড ক্যাটাগরি ইন্ডাস্ট্রি’র তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ এগুলি থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়াতে পারে। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবে কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকায় এই ধরনের কারখানার অনুমতি দেওয়া হয় না। পরিবেশ দফতর সূত্রের খবর, এই ধরনের কোনও ব্যাটারি কারখানার ছাড়পত্র তাদের থেকে নেওয়া হয়নি। তবু জনবসতি এলাকায় রমরমিয়ে ব্যাটারির কারখানা চলছে কী ভাবে? প্রশাসনের কোনও মহল থেকে সেই উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে পেয়ারাবাগান এলাকার ব্যাটারি কারখানাগুলি কলকাতা পুরসভার ২ নম্বর বরোর অন্তর্গত। বরো চেয়ারম্যান সাধন সাহা বললেন, ‘‘মানছি দূষণ ছড়ায়, কিন্তু কারখানাগুলি অনেক পুরনো। আমিই বা কী করব!’’ পঞ্জাবি গ্যারাজ এলাকা ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে পড়ে। কাউন্সিলর শান্তিরঞ্জন কুণ্ডুর বক্তব্য, ‘‘ব্যাটারি অত খারাপ বলে তো শুনিনি। খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘এ রকম যদি হয়ে থাকে, তা একেবারেই বেআইনি। আমরা এ ধরনের কারখানা কোনও মতেই সমর্থন করি না। এগুলি হল ‘রেড ক্যাটেগরি’।’’ তবে এই সব কারখানার খবর কেন পর্ষদের কাছে নেই, সেই উত্তর মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy