পৃথিবীজুড়ে এত কথা-গান-প্রাণ বাকি, এত দ্রুত কি অস্তগামী হওয়া যায়?
ওঁরা তাই প্রবল ভাবে জীবনে ফিরেছেন। উদ্বুদ্ধ করছেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হারতে বসা অন্য অনেক জীবনকেও। ক্যানসার ও মৃত্যু সমার্থক নয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দিয়ে করমর্দন করেছেন জীবনের সঙ্গে।
মোট ২৬ জন। কনিষ্ঠ ১৯, জ্যেষ্ঠতমা ৭০। অধিকাংশই স্তন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে সুস্থ হওয়ার মুখে। বাকিদের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি, গলা, রক্ত বা জিভে থাবা বসিয়েছিল রোগ। কিন্তু রোগ হার মেনেছে রোগীদের মনের জোর ও জীবনের জেদের কাছে। ওঁরা ‘ক্যানসার সার্ভাইভার্স’ বা ক্যানসার-জয়ী।
প্রত্যেকেই চিকিৎসা করিয়েছেন পিজি-র অঙ্কোসার্জন দীপ্তেন্দ্র সরকারের কাছে। দীপ্তেন্দ্র আর তাঁর চিকিৎসক স্ত্রী অগ্নিমিতা বহু দিন খুঁজছিলেন, কী ভাবে ক্যানসার-আক্রান্তদের মানসিক ভাবে ইতিবাচক রাখা যায়। মনের জোর হারালে রোগের সঙ্গে যুঝতে পারাও অসম্ভব হয়ে ওঠে।
মাস ছয় আগে আচমকাই পরিকল্পনাটা মাথায় আসে। প্রস্তাবটা দিতেই এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে দল গড়েন সৌমি, ঝর্ণা, অপর্ণা, সীমারেখা, অনিন্দিতা, মৈত্রেয়ী, জয়শ্রী-র মতো ‘ক্যানসার জয়ী’রা। অগ্নিমিতা বলছিলেন, ‘‘ক্যানসার ধরা পড়লে রোগীর প্রথম মনে হয়, ‘মরে যাব। জীবন থেমে যাবে।’ তখন একই অভিজ্ঞতার কেউ যদি বলেন, ‘আমাকে দেখো। আমি যখন ভাল আছি, তুমিও থাকবে’, সেটুকু আশ্বাসেই কাজ হয়।’’
দীপ্তেন্দ্র বলেন, ‘‘ধরা যাক ২২-২৩ বছরের একটি মেয়ের ক্যানসার ধরা পড়েছে। মানসিক বিপর্যয় ছাড়াও কেমোথেরাপিতে চুল উঠে, চামড়া, ঠোঁট, নখ কালো হয়ে চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেল। হয়তো স্তনও বাদ গেল। ‘ট্রমা’ শুরু হয়। তখন এক জন ক্যানসার জয়ী যদি বলেন, ‘‘আমারও এমন হয়েছিল। আবার সুন্দর হয়ে গিয়েছি। তুমিও ঠিক হবে। তা হলে লড়াইটা সহজ হয়।’’ ঠিক এর জন্যই পথচলা শুরু ক্যানসার-জয়ী মহিলাদের দলটার— পিজি-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে রোগীদের কাউন্সেলিং, পরিজনদের ভরসা দেওয়া ও সচেতনতা অভিযান চালানো। শেষেরটির হাতিয়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ-গান-অভিনয়-কবিতায় বার্তা দিতে চাইছেন, বাঁচতে হলে হইহই করেই বাঁচতে হবে। ৭ জুন ‘ক্যানসার সার্ভাইভার্স ডে’-র আগের দিন লেক গার্ডেন্সের একটি বাড়িতে দুপুরবেলা তারই মহড়া চলছিল।
বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে বাঘা যতীনের বাসিন্দা অনিন্দিতা কুণ্ডুর (৩৬)। একটি স্তন বাদ গিয়েছে। বলছিলেন, ‘‘৮ সাইকেল কেমো আর ২৫ সাইকেল রেডিয়েশন হয়েছিল। চুল উঠে নাক-ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছিল। আবার ঠিক হয়েছে। যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের বলব— দরকারে উইগ পরুন, লিপস্টিক মাখুন, কাজল পেনসিলে ভুরু আঁকুন। আবার আগের মতো হয়ে যাবেন।’’ সন্তোষপুরের বাসিন্দা দর্শনের অধ্যাপক অপর্ণা মজুমদার কেমোথেরাপি শুরুর আগে ঘাবড়ে না গিয়ে ৫ বছরের ছেলেকে বুঝিয়েছিলেন, ‘‘আমাকে কিছু দিনের জন্য দেখতে একটু খারাপ হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেও না।’’ ছেলে বুঝেছিল। অপর্ণার কথায়, ‘‘ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করা জরুরি। বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতাও খুব জরুরি।’’
ক্যানসার চিকিৎসক শারদ্বত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যানসার-জয়ীরা যদি আক্রান্তদের কাউন্সেলিং করেন, রোগীদের আতঙ্ক অনেকটা কমে।’’ প্রবীণ ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, এ দেশে ক্যানসার জয়ীদের মাত্র ৫-১০ শতাংশ নিজেদের ‘ক্যানসার সার্ভাইভার’ পরিচয় প্রকাশ করতে চান। তিনি বলছিলেন, ‘‘এক মহিলা আমার কাছে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর গল্প শুনে অনেকে সাহস পাবেন জানিয়ে তাঁকে বিষয়টি সর্বসমক্ষে আনতে বলি। কিন্তু তিনি রাজি হননি।’’ ব্যতিক্রমও আছেন। যেমন বিভূতিভূষণ চক্রবর্তী। ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় জানান, স্বরযন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত বিভূতিবাবু কী ভাবে পরবর্তীকালে স্বর-হারানো রোগীদের স্পিচ থেরাপি করে বিকল্প পদ্ধতিতে কথা বলতে সাহায্য করতেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের প্রতিটি পরিবারে অন্তত এক জন ক্যানসার রোগী থাকতে চলেছেন। এই সঙ্কটের সময়ে পরস্পরের জন্য এটুকু হাত বোধহয় বাড়াতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy