Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

আলপনা ভুলে রঙ্গোলিতে বর্ণিল দীপাবলি বাঙালির

সোশ্যাল মিডিয়া সাক্ষী, কালীপুজো-দেওয়ালির আমেজে এই বাংলা মুলুক বা শহর কলকাতার ঘরে-ঘরে রঙ্গোলি-র বাহার। একদা গিরিশ পার্ক, অধুনা বারাসতের বাসিন্দা সপ্তর্ষি বল্লভ সগর্বে তাঁর শিল্পকলার নমুনা হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের সামনে মেলে ধরছেন।

রঙিন: নানা রঙের সুচারু নকশায় উৎসব যাপন। বুধবার, হাওড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

রঙিন: নানা রঙের সুচারু নকশায় উৎসব যাপন। বুধবার, হাওড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০১
Share: Save:

এক মুঠো চাল, জল ভেজা রঙে আর মন ভিজছে না! বাড়ির দরজায় চৌকাঠের কাছে বা দালানে যৎসামান্য উপকরণেই চোখ জুড়নো নকশা ফুটিয়ে তুলতেন বটে মা-ঠাকুরমারা। কিন্তু নতুন যুগের বাঙালি নতুন নকশা, নতুন রঙে মজেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া সাক্ষী, কালীপুজো-দেওয়ালির আমেজে এই বাংলা মুলুক বা শহর কলকাতার ঘরে-ঘরে রঙ্গোলি-র বাহার। একদা গিরিশ পার্ক, অধুনা বারাসতের বাসিন্দা সপ্তর্ষি বল্লভ সগর্বে তাঁর শিল্পকলার নমুনা হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের সামনে মেলে ধরছেন। পরতে পরতে বিচিত্র রঙের প্রলেপে বসানো এক-একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। আলোয়-ছায়ায় অদ্ভুত মায়া মাখামাখি! ‘হ্যাপি দিওয়ালি’-র সম্ভাষণের ফাঁকে মুগ্ধ বন্ধুদের বলতে ভুলছেন না সপ্তর্ষি, ‘‘সবটাই আমার তৈরি। ছাঁচের সাহায্য নিইনি।’’ এক সময়ে মায়ের আলপনার থেকে ছক-ভাঙা কিছু করতে চাইছিলেন সপ্তর্ষি। সেই শুরু রঙ্গোলির। এখন মনে হচ্ছে, আলপনাও রঙ্গোলির জৌলুসে পিছু হটেছে।

ঘরোয়া নান্দনিকতা থেকে একদা বাঙালির সামাজিক জীবনে চেনা সাংস্কৃতিক মোটিফ হয়ে উঠেছিল আলপনা। কিন্তু সে সবই এখন সিপিয়ারঙা অতীত। তার বদলে এ যেন রংচঙে উজ্জ্বল জগতে পদার্পণ। অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বঙ্গজীবনে পড়ছে নানারঙা প্রভাব। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় হাসছেন, ‘‘এ সবই সর্বভারতীয় প্রভাব। বিয়েয় সঙ্গীত-এর জমকালো আসর, ঘর সাজানোর ঢঙেও উত্তর বা পশ্চিম ভারতের প্রভাব।’’ তবে এই ভিন ঘরানার সংস্কৃতি আমদানিতে বাঙালি অস্মিতা বিপন্ন হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না। তাঁর মতে, ‘‘এমন ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে, মিলিবে’ মন্দ কী!’’

আলিপুরে পোর্টল্যান্ড পার্কের বাসিন্দা পারমিতা ঘোষ মজুমদার বলছিলেন, তাঁর হিন্দিভাষী পড়শিদের কথা! ‘‘বিজয়ায় মিষ্টি খেয়ে ওঁরা খুব খুশ্! ওঁরাই বললেন, কালীপুজোর দিনেই আমার বাড়ি রঙ্গোলিতে সাজাবেন! আমি এক কথায় রাজি।’’ কলকাতার কাশী বোস লেনের পুজোর অন্যতম প্রাণপুরুষ সদ্যপ্রয়াত গোবিন্দরাম চৌধুরীর পুত্রবধূ সোনিয়া চৌধুরী পুলকিত, ‘‘আগে দিওয়ালিতে রঙ্গোলির রং সহজে পেতাম না! অনেক সময়ে বাঙালি রীতির চালগুঁড়োর গোলায় রং মিশিয়েই কাজ চালাতাম।’’ মহেশতলায় বাঙালি-বাড়ির পঞ্জাবি বৌমা তৃপ্তি ঘোষাল সগর্বে বলছেন, ‘‘আমার শ্বশুরবাড়ির সক্কলে এখন রঙ্গোলিরই বেশি ভক্ত!’’

আবাসনে আবাসনে চলছে রঙ্গোলির প্রতিযোগিতা! বাগুইআটির রামানুজ সেনের কন্যা মিঠাইওবাবার কাছ থেকে রঙ্গোলি আঁকার সহজ নকশার বই আর সরঞ্জাম পেয়ে লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে বসে! নানা নকশা ফুটিয়ে তুলে মা-বাপকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে মেয়ে। তবে রঙ্গোলির এই জনপ্রিয়তার মানে, খুব সহজে যে কেউ সেই নকশা ফুটিয়ে তুলতে পারে, ভাবাটা ঠিক নয় জোর গলায় বলছেন ঘরোয়া শিল্পীদের অনেকেই। রঙ্গোলির ক্ষেত্রে গুঁড়ো-গুঁড়ো ‘স্যান্ড কালার’-এর চল হয়েছে। নকশা-কাটা চালুনিতে সেই রং একটু ঝাঁকিয়ে নিলেই গুঁড়ো-গুঁড়ো ঝরে পড়ে নকশা তৈরি। ইদানীং আলপনাও অনেকে স্টেনসিলের সাহায্যে আঁকেন। সাবেক চালগুঁড়ির রঙের বদলে পোস্টার কালার ব্যবহার করেন। আলপনাকে বাঙালির সামাজিক জীবনে ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে স্মরণীয় ভূমিকা নন্দলাল বসুর। শান্তিনিকেতনে কিন্তু এখনও সব অনুষ্ঠান-উৎসবেই আলপনার রমরমা। কলাভবনের শিল্পের ইতিহাসের শিক্ষক সৌমিক নন্দী মজুমদারের অবশ্য দাবি, ‘‘রঙ্গোলি, আলপনা— দু’টোই কয়েকশো বছরের পুরনো ঘরানা। দেওয়ালিতে রঙ্গোলি থাকলেও সরস্বতী ও লক্ষ্মী পুজোয় এখনও আলপনাই শেষ কথা!’’

লাল মেঝের উপরে ধবধবে সাদা রেখার জন্য কিছু কাঙালপনা এখনও বেঁচে, কোনও কোনও প্রবীণের কাছে এটাও সান্ত্বনা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Diwali Rangoli Alpana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE