কথাবার্তা: ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মূল্যবোধের শিক্ষা প্রসঙ্গে এক আলোচনাসভায়। নিজস্ব চিত্র
রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে পানের পিক ফেলা, পথচলতি মানুষের অসহিষ্ণুতা, ধাক্কাধাক্কি করে ভিড় মেট্রো থেকে ওঠানামা— এ সবই এই শহরের নিত্য দিনের চিত্র।
কোন মূল্যবোধের শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ধরনের অমানবিকতা থেকে বাঁচাতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলছে শহর। এমনই প্রশ্ন নিয়ে একটি আলোচনাচক্রের মাধ্যমে আনন্দবাজার পৌঁছেছিল একদল শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে। প্রশ্ন ছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও সমাজ-সচেতন করতে কি শিক্ষা ব্যবস্থায় রদবদল প্রয়োজন?
ত্রিবেণী টিস্যু বিদ্যাপীঠের শিক্ষিকা পিয়ালী দে জানালেন, তাঁদের স্কুলে মূল্যবোধের পাঠ দেওয়া হয়। কিন্তু তা সীমিত রয়েছে নিচু ক্লাসেই। উঁচু ক্লাসে পৌঁছে ছাত্রছাত্রীরা সেই পাঠ নিচ্ছে না। তেগা সিএসআর স্কুলের শিক্ষক ভিক্টর আমবেদের প্রশ্ন, ‘‘মূল্যবোধ শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকার থেকেও বাবা-মায়ের ভূমিকা বেশি নয় কি? বাচ্চা স্কুলে এক রকম শিখে বাড়িতে গিয়ে অন্য কিছু দেখলে বিভ্রান্ত হবে না?’’
শ্রীশিক্ষায়তন ফাউন্ডেশনের অন্যতম কর্তা বিনোদ আগরওয়ালের আক্ষেপ, এখনকার বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার থেকেও সফল হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক বেশি সচেষ্ট। বিড়লা হাইস্কুলের শিক্ষিকা রাজশ্রী চৌধুরী বলছেন, ‘‘শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বাবা-মাকে একসঙ্গে এই নিয়ে কাজ করতে হবে। বাবা-মাকে বাচ্চাদের দিকে আরও সময় দিতে হবে।’’ সন্তান ঠিক মতো স্কুলে বা টিউশনে পৌঁছল কি না, তা জানার জন্য যে স্মার্ট ফোন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজশ্রী।
এ ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের প্রসঙ্গ তোলেন লিলুয়ার এমসি কেজরিওয়াল বিদ্যাপীঠের শিক্ষক অজয় সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘যৌথ পরিবারের বাচ্চাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা অনেক বেশি। আজকের বাচ্চাদের মধ্যে তা দেখা যায় না।’’ টেকনো ইন্ডিয়া স্কুলের প্রিন্সিপাল অভিজিৎ চক্রবর্তীও ওই বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘‘আজকাল বাচ্চারা কত ক্ষণ সময় কাটায় ঠাকুর্দা-ঠাকুরমার সঙ্গে? মূল্যবোধের প্রাথমিক পাঠ তো আমরা ছোটবেলায় তাঁদের কাছেই পেয়েছি।’’
এমসিকেভি স্কুলের শিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা পালের অভিযোগ, ‘‘এখনকার প্রজন্মের কাছে অনুসরণ করার মতো মানুষ নেই। যাঁকে আমরা রোল মডেল বলি। কাকে দেখে বাচ্চা শিখবে?’’ বাড়িতে শিশুর কান্না বন্ধ করার জন্য তার চাহিদা মতো পিৎজা বা বার্গার এনে দিচ্ছেন বাবা-মা, অথচ মূল্যবোধের পাঠ দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ওই স্কুলের শিক্ষক অম্বরীশ চট্টোপাধ্যায়। সেখানকারই শিক্ষিকা সঞ্চিতা সরকার মনে করেন, যত বেশি পরিবেশের কাছে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া যাবে, তত সহিষ্ণুতা বাড়বে।
জামশেদপুরের জে এইচ তারাপুর স্কুলের শিক্ষিকা বিনীতা প্রসাদ জানিয়েছেন, কী ভাবে সামাজিক বিভিন্ন সেবামূলক কাজের মধ্যে দিয়ে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের এই মূল্যবোধের পাঠ দিচ্ছেন। ফিউচার ফাউন্ডেশনের শিক্ষিকা জয়ন্তী ভট্টাচার্য অবশ্য এই শিক্ষা ব্যবস্থা বা বাড়ির দিকে দোষারোপের আঙুল তোলা বন্ধ করে নিজেদের দিকেই তাকাতে বলছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মূল্যবোধের পাঠ কী করে একটি ক্লাসঘরের মধ্যে
সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব? সমাজের প্রতিটি স্তর থেকেই সেই মূল্যবোধের পাঠ আসা উচিত।’’
শিক্ষাবিদ সেন্থিল কুমার বলেন, ‘‘যতক্ষণ কোনও শেখাকে বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হবে, ততক্ষণ পরীক্ষায় পাশ করার জন্য বাচ্চারা পড়বে। কিন্তু শিখবে না। বাচ্চাদের মনের আরও কাছাকাছি পৌঁছতে হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্টপ টিচিং, স্টার্ট রিচিং।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy