Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সোনাগাছিতে রক্তদান শিবির, হাজির মন্ত্রীও

সোনাগাছিতে রক্তদান শিবির। তা-ও আবার রাজ্যের দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে। যাঁদের এক জন নিজে পেশায় চিকিৎসক। শনিবার ওই শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে আসেন মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা। এলাকায় হাজির হয়েই তাঁরা আপত্তি তুলেছিলেন । কিন্তু তাঁদের সেই আপত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

সোনাগাছিতে রক্তদান শিবির। তা-ও আবার রাজ্যের দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে। যাঁদের এক জন নিজে পেশায় চিকিৎসক।

শনিবার ওই শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে আসেন মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা। এলাকায় হাজির হয়েই তাঁরা আপত্তি তুলেছিলেন । কিন্তু তাঁদের সেই আপত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। ঘটনাচক্রে, মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে এখন রক্ত পরীক্ষার বিভিন্ন কিটের আকাল চলছে। এই পরিস্থিতিতে শনিবারের ওই শিবির থেকে সংগৃহীত রক্ত কতটা পরীক্ষা হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সোমবার ওই রক্তের কয়েক ইউনিট ইতিমধ্যেই বাইরের কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছে বলে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্রে খবর। সমস্ত নিয়মকানুনকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে কী ভাবে জনস্বাস্থ্য নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা।

নিয়ম অনুযায়ী, কোনও যৌনপল্লীর ভিতরে বা তার এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা যায় না। কারণ একাধিক যৌনসঙ্গী যাঁদের থাকে, তাঁদের রক্তে এইচআইভি-সহ নানা যৌনরোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়। শুধু যৌনকর্মী নয়, যারা নিয়মিত মাদক সেবন করেন বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক নেন— সংক্রমণের আশঙ্কা রুখতে তাঁদের শরীর থেকেও রক্ত নেওয়া নিষিদ্ধ।

সব কিছু জানা সত্ত্বেও কী ভাবে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক ওখানে রক্ত সংগ্রহে যেতে রাজি হল? ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার বলেন, ‘‘আমরা জানি এই ভাবে রক্ত সংগ্রহ করা উচিত হয়নি। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের হাত-পা বাঁধা। চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হচ্ছে।’’ কী ধরনের চাপ? তিনি বলেন, ‘‘এর চেয়ে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ কুমারেশবাবু না বললেও ব্লাড ব্যাঙ্কের অন্য কয়েক জন শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, শাসক দলের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন ক্লাবের কাছ থেকেই এই ধরনের নানা আবদার আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতা-মন্ত্রীরাও ফোন করে চাপ দেন। ফলে না বলার উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ওই শিবিরে হাজির থাকা এক স্বাস্থ্যকর্মীও বলেন, ‘‘বেশ কয়েক জন মদ্যপ অবস্থায় রক্ত দিতে এসেছিলেন। আমরা সেই রক্ত নিতে চাইনি। কিন্তু ক্লাবের তরফ থেকে আমাদের বলা হয়েছিল, রক্ত নিতেই হবে।’’

ওই রক্তদান শিবিরে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী, সাধন পাণ্ডে এবং শশী পাঁজা। ছিলেন তৃণমূল কাউন্সিলর বিজয় উপাধ্যায়ও। নিজে চিকিৎসক হয়ে শশী পাঁজা কী ভাবে ওই রক্তদান শিবির অনুমোদন করলেন? শশীর উত্তর, ‘‘সংগ্রহ করা রক্ত তো পরীক্ষা করেই অন্যদের দেওয়া হবে। কোনও সংক্রমণ থাকলে সেটা ধরা পড়বে। তখন সেই রক্ত ফেলে দিলেই হবে।’’ কিন্তু জীবাণু যদি উইন্ডো পিরিয়ডে থাকে, তা হলে রক্ত পরীক্ষা করেও তা ধরা পড়বে না। আর সেই কারণেই রক্তদান শিবিরের এলাকা নিয়ে এত সতর্কতাবিধি রয়েছে। কারণ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ দেশে সাধারণ ভাবে রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে যে ধরনের কিট ব্যবহৃত হয়, তাতে অ্যান্টিবডি নির্ণয় করা যায়। কিন্তু অ্যান্টিজেন নির্ণয় করা যায় না। অ্যান্টিজেন নির্ণয়ের জন্য যে কিট লাগে, তা ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু শরীরে জীবাণু ঢোকার পরে তা অ্যান্টিবডিতে ধরা পড়তে দু’সপ্তাহ থেকে ছ’মাস পর্যন্ত সময় লাগে। সেই কারণেই সুরক্ষার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য সাবধান থাকতে বলা হয়। হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যৌনপল্লির মতো ‘হাই রিস্ক জোন’-এ রক্তদান শিবির কোনও ভাবেই করা যায় না। অন্য কোনও এলাকাতেও কোনও দাতার সঙ্গে কথা বলে যদি চিকিৎসকের সন্দেহ হয়, তা হলে তিনি তাঁকেও বাতিল করতে পারেন।’’ শশী পাঁজাও পরে স্বীকার করেন, ‘‘ওখানে কারা রক্ত দিতে আসবেন, সে বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানতাম না।’’

শিবিরের উদ্যোক্তারা অবশ্য দাবি করছেন, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের উৎসাহেই তাঁরা শিবিরটি আয়োজন করেছিলেন। ৭২ জন ওই শিবিরে রক্ত দেন। প্রায় সকলেই ওই এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু যৌনকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ আটকানোর জন্য তো কন্ডোম সচেতনতা বাড়ানোর প্রকল্প রয়েছে। তার পরেও সংক্রমণের আশঙ্কা থাকছে কেন? যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির কর্মীরা জানিয়েছেন, আগের তুলনায় তাঁরা অনেকটা পথ এগিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এখনও বহু পথ বাকি। দুর্বারের এক কর্মীর কথায়, ‘‘আমরা বারবার বোঝানোর পরেও বহু যৌনকর্মী তাঁদের ‘বাবু’কে স্বামী বলে মনে করেন এবং কন্ডোম ব্যবহার করেন না। তা ছাড়া কন্ডোম ব্যবহার না করার শর্তে বেশি টাকার টোপও দেন বহু খদ্দের।’’ ফলে যৌনপল্লি এখনও সংক্রমণের একটা বড় উৎস থেকে গিয়েছে।

তার পরেও কেন এলাকায় রক্তদান শিবির হল? আয়োজক ক্লাবের সম্পাদক রাজেশ জয়সওয়াল জানাচ্ছেন, ‘’১২ বছর আগে শেষ এ ধরনের শিবির করেছিলাম। তখন আমাদের ক্লাবের প্রচুর রমরমা ছিল। তার পরে নানা কারণে সেই রমরমা কমে গিয়েছিল। সেটা ফেরত পেতে চেয়েছি।’’ কিন্তু ক্লাবের হৃতগৌরব ফেরত পেতে গিয়ে সাধারণ মানুষের রক্তসুরক্ষা নিয়ে এ ভাবে ছেলেখেলা করলেন? কোনও উত্তর রাজেশবাবুর কাছে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় তৃণমূলকাউন্সিলর বিজয়বাবু প্রশ্নটিকেই নস্যাৎ করে বললেন, ‘‘কে বলল ওই এলাকায় রক্তদান শিবির করা যায় না? আমরা তো স্বাস্থ্য সমিতি নামে একটা ক্লাবের ভেতরে শিবিরটা আয়োজন করেছি। এতে আপত্তির কোনও জায়গাই নেই।’’ কিন্তু রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের এক কর্তা জানালেন, ‘‘ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন বা ন্যাকোর গাইডলাইনেও যৌনপল্লি বা তার আশপাশে রক্তদান শিবিরের আয়োজন নিষিদ্ধ। কী ভাবে নেতা-মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে এটা করা হল ভেবে অবাক লাগছে।’’ রক্তদান সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘রক্তদানের যে ‘স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল, সেখানেও এটা স্পষ্ট বলা আছে। যাঁরা ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ওই রক্ত নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ালে দায় নেবে কে?’’ স্বাস্থ্য দফতরের মুখে কুলুপ। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, ‘‘বিষয়টা জানতাম না। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE