৩৭৭ ধারায় অপরাধীর তকমা মুছে যেতেই নানা বদল চোখে পড়ছে উৎসবের আঙিনায়। —ফাইল চিত্র।
পরনে ধুতি, কপালে তিলক। গলার তুলসীমালার লকেটে তাঁর রাধারানিকে নিয়ে পুজোয় বসেছেন কবিরাগ পোদ্দার তথা কেতকী। ধর্মনিষ্ঠ বৈষ্ণব ছোটখাটো চেহারার রূপান্তরকামী পুরুষ এ বার পুরোহিতের ভূমিকায়। নিয়মিত চণ্ডীপাঠের সঙ্গে কবিরাগের ভাগবত-পাঠের সুরেও পুজোর অঙ্গন মথিত হচ্ছে।
ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন থেকে নবমীর পুজোর অর্ঘ্য নিবেদনে আবার পুরোভাগে ছকভাঙা নারীসত্তা। রূপান্তরকামী নারী অনুরাধা, অনিতা মেয়েলি সমকামী পুরুষ অচিন্ত্য কিংবা রূপান্তরকামী পুরুষের সঙ্গিনী অপর্ণাদের দম ফেলার ফুরসত নেই।
কুমোরটুলিতে বায়না দেওয়া প্রতিমাও খানিক অন্য ধাঁচের। মায়ের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। মাতৃপুজোর সাবেক পরম্পরার মধ্যেই ব্যকরণ ভাঙার তাগিদ ফুটে উঠছে। পুজোর সঙ্কল্প করবেন রূপান্তরকামী নারী তথা সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিংহ। তিনি বললেন, ‘‘পুজো থেকে আমরাই বা দূরে কেন থাকব! পুজো করব, পুজো ঘিরে ব্রাহ্মণ্যবাদী, পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলোও ওলটপালট করে দেব।’’ এ পুজোয় রঞ্জিতার গোখেল রোডের ফ্ল্যাটবাড়িটাই হয়ে উঠছে পুজোর চিরকেলে আচার-ভাঙা মুক্তির আকাশ।
দুর্গোৎসবের মাসখানেক আগে সুপ্রিম কোর্টে ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারায় অপরাধীর তকমা মুছে যেতেই নানা বদল চোখে পড়ছে উৎসবের আঙিনায়। রূপান্তরকামী, সমকামী তথা তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষজন আগের থেকে ঢের সাদরে গৃহীত হচ্ছেন পুজোর আসরে। তবু কোথাও একটা ফাঁক ভিতরে-ভিতরে টের পাচ্ছিলেন অনেকেই। তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের নিজেদের পুজোর জন্য তখনই পাতানো মা বা দিদি রঞ্জিতার কাছে অনেকেই আবদার পাড়তে থাকেন। শেষমেশ তারই ফলশ্রুতিতেই রঞ্জিতার বাড়ি সাজছে পুজোর সাজে।
কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিতবিহীন পুজো আবার হয় না কি? দুর্গাপুজোর সঙ্গে দীর্ঘদিন যুগ্ম পুরোহিতদের একাংশ বা শাস্ত্রবিদদের কেউ কেউ, এ পুজো বৈধ না অবৈধ ভেবে সময় নষ্ট করতে চান না। ‘‘ঠিক, ভুলের প্রশ্নটাই অবান্তর’’, বলছেন প্রবীণ পুরোহিত সতীনাথ ভট্টাচার্য। ‘‘কারণ, আগে তো আর তৃতীয় লিঙ্গভুক্তরা এগিয়ে এসে পুজোর আয়োজন করতেন না।’’ তবে সতীনাথবাবুর মত, ‘‘নিজের পুজো সব সময়েই নিজে করা যায়। কিন্তু অন্যের পুজো করার অধিকার ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরই।’’ পুরাণে-মহাকাব্যে অবশ্য মোহিনীবেশী বিষ্ণু বা শিখণ্ডীরূপী অম্বারা ভরপুর। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, ‘‘ঈশ্বর তো ভাবগ্রাহী। ভক্তের রূপ দেখেন না। তাঁর পুজোয় সবারই অধিকার।’’
এমনিতে তো দুর্গাপুজো মানে রামায়ণের কাহিনী মেনে রাবণবধের আশায় রামচন্দ্রের হাতে মায়ের অকালবোধন। তবে রঞ্জিতার বাড়ির পুজোর ভাবনা অন্য রকম। প্রধান পুরোহিত কবিরাগের কথায়, ‘‘আমি পুজো করছি বৈষ্ণব মতে। ঝুলনপূর্ণিমা থেকে রাসপূর্ণিমা, রাধারানির কাত্যায়নী ব্রত। রাসে গোবিন্দকে পাওয়ার আশায় কাত্যায়নী বা যোগমায়ার পুজো করেছিলেন রাধারানি।’’ রঞ্জিতার মনে পড়ছে, ছোটবেলায় মায়ের দেখাদেখি দুর্গাপুজোয় নবরাত্রির উপোসের কথা। মা নেই। তাঁর দেখানো পথেই পুজোয় মাতবেন মেয়ে। সুন্দরবনের সরবেড়িয়ার অনুরাধা, টালিগঞ্জের বৈশালী, বাঘা যতীনের অনিতারা মনে নারী হয়েও শরীরে পুরুষ ছিলেন কৈশোরে। সাধ মিটিয়ে শাড়ি পরে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সাধ পূরণ হয়নি অনেকেরই। ‘রঞ্জিতাদি’র বাড়ির পুজো তাঁদের অনেকেরই ইচ্ছাপূরণের পুজো।
অষ্টমীর কুমারীপুজো, ভাসানের সিঁদুরখেলার আসরও প্রান্তিকতার উদ্যাপনে ভরে উঠছে এখানে। রঞ্জিতারা ঠিক করেছেন, কুমারীপুজোর আদলে এক ঝাঁক পথশিশু ছেলেমেয়ের পুজো হবে। মহালয়ার পর থেকে ন’দিন ধরেই পুজোর আসরে আসবেন পরিবারে ব্রাত্য নিঃস্ব বৃদ্ধারা, ভিন্ ধর্মের মেয়েরা, যৌনকর্মীরা কিংবা ছক ভাঙা দম্পতিরাও। সবার রঙে রং মিশিয়ে মুক্তির পুজোর গানের ডাকটা উঠে আসছে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের হাত ধরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy