বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভোলানাথ সিংহ
জমি দখলের অভিযোগ উঠল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মহল্লায়। বলতে গেলে, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায়। ভবানীপুরে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তাঁর নিকট পড়শির জমিতে জবরদস্তি কব্জা কায়েমের চেষ্টা চালানোর জন্য আঙুল উঠেছে যাঁর দিকে, তিনিও যে-সে কেউ নন। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি আপন জন— তাঁর ভাই স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বাবুন।
এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় পুলিশ, পুরসভা সকলেই নির্লিপ্ত হয়ে রয়েছে বলে আক্ষেপ করছেন ভোলানাথ সিংহ, যাঁর জমি ঘিরে দখলদারির এই নালিশ। ভোলানাথবাবুর এ-ও দাবি, ব্যাপারটা জানিয়ে স্বয়ং মমতাকে তিনি একাধিক চিঠি লিখেছেন, তবু প্রতিকার পাননি। রাজভবনের কাছে দরবারও বৃথা গিয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি নিজের জমিতেই কার্যত পা রাখতে পারছেন না বলে তাঁর অভিযোগ। বাবুনবাবু অবশ্য এ সব সরাসরি অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় থানা ও পুর-প্রতিনিধির তরফেও এমন ঘটনার কথা নস্যাত্ করা হয়েছে।
মমতার বাড়ির ঠিকানা ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট (প্রেমেন্দ্র মিত্র সরণি)। ভোলানাথবাবু জানিয়েছেন, লাগোয়া বাবুনবাবু থাকতেন ৩০এ-তে। এখন তিনি তার পিছন দিকে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন। আর তার পাশে ২৯/১ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে সিংহ পরিবারের প্রায় সাড়ে চার কাঠা জমি নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত। কী রকম?
আদতে ভবানীপুরের রাখাল মুখার্জি রোডের বাসিন্দা ভোলানাথবাবুর দাবি: তাঁদের ইট-বালি-সুরকি সরবরাহের পারিবারিক ব্যবসার অফিস রয়েছে ওই জমিতে। তাঁর অভিযোগ, বহু দিন ধরেই জমিটির উপরে বাবুনবাবুর নজর। কয়েক বছর আগে ওই জমির পাশে বাবুনবাবু নতুন বাড়ি তোলেন, এবং তাঁর জমি দিয়েই যাতায়াত শুরু করেন। ভোলানাথবাবুর দাবি, তাঁর জমিতে বাবুনবাবু এক বার দুর্গাপুজো করার চেষ্টাও করেছিলেন, যদিও পুলিশের হস্তক্ষেপে তা আটকে যায়।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হতেই তাঁর জমি কার্যত বেদখল হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন ভোলানাথবাবু। প্রৌঢ়ের অভিযোগ, ২০১১-র মে মাসে রাজ্যে তৃণমূল সরকার গঠনের দিন দুয়েক পরেই বাবুনবাবু সিংহ পরিবারের জমিতে দলীয় অফিস ফেঁদে বসেন। টিন-দরমা দিয়ে খাড়া করা অফিসঘরটি ভেঙেচুরে যাওয়ার বছরখানেক আগে তা সরিয়ে ফেলা হলেও জমি এখন হরেক মালে বোঝাই। বাবুনবাবুর আত্মীয়-বন্ধুদের গাড়িও মাঝে-মধ্যে সেখানে রাখা হয়। উপরন্তু ভোলানাথবাবুর দাবি, বাবুনবাবুর বাড়িতে পুরসভার জলের লাইন তাঁর জমির তলা দিয়ে টানা হয়েছে শুধু নয়, তাঁর জমির নিকাশির সঙ্গে বাবুনবাবুর বাড়ির নর্দমাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রৌঢ়ের কথায়, “জলের পাইপ বসাতে বাধা দিয়েছিলাম। শাসানি শুনে আর সাহস পাইনি।” আর এ সবের জেরে ওই জমিতে বসবাসকারী ভোলানাথবাবুর কয়েক ঘর ভাড়াটেও বিপাকে পড়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। ভোলানাথবাবু বলেন, “ভাড়াটেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা উঠে যায়। মাঝখান থেকে আমি ভাড়ার টাকা নিয়মিত পাচ্ছি না।”
ভাড়ার ঘরগুলিতে থাকেন সীতারাম জায়সবাল, প্রদীপ সিংহ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ জায়সবাল, টুঙ্কু হালদার, দীপক সিংহ, অম্বিকা পণ্ডিতের পরিবার। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাঁদের এক জন বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। ঝামেলায় পড়তে চাই না।” বাবুনবাবু অবশ্য এ সব অভিযোগ ধর্তব্যেই আনছেন না। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের ঝামেলায় আমাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উনি (ভোলানাথ সিংহ) আমাকে অপদস্থ করতে চাইছেন। আমি কারও জমি দখল করিনি, কাউকে ভয়ও দেখাইনি।” ভোলানাথবাবুর মানসিক কিছু সমস্যা আছে বলেও তাঁর দাবি। অন্য দিকে ভোলানাথবাবুর বক্তব্য, তাঁর সাড়ে চার কাঠার জমিটা স্রেফ দু’লাখ টাকা দিয়ে বাবুনবাবু কিনে নিতে চেয়েছিলেন। “রাজি না-হওয়ায় এ ভাবে আমাকে কার্যত উত্খাত করে দেওয়া হল।”— বলছেন তিনি।
সেই বিতর্কিত জমি। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
পুলিশকে জানাননি?
ভোলানাথবাবু আক্ষেপ করেছেন, “পুলিশ, পুরসভা, কাউকে বাদ দিইনি। রাজভবনে লিখিত নালিশ করেছি। খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে বারবার চিঠি দিয়েছি। কোনও কাজ হয়নি।” কালীঘাট থানায় তিনি বার পাঁচেক লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। প্রথমটি ২০১১-র ২৯ মে। শেষটি গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। পুলিশের দাবি, তদন্ত করে অভিযোগের সমর্থনে কোনও প্রমাণ মেলেনি। “উনি ভুয়ো অভিযোগ করছেন। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তেমন কিছু খুঁজে পাইনি।”— মন্তব্য করেছেন কালীঘাট থানার এক অফিসার। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ যে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিল, বাবুনবাবুও তা স্বীকার করেছেন।
পাশাপাশি ২০১৩-র এপ্রিলে ডাকযোগে স্থানীয় পুর-প্রতিনিধিকেও চিঠি দিয়েছিলেন ভোলানাথবাবু। কিন্তু পুরসভার সংশ্লিষ্ট ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের সেই তৃণমূল কাউন্সিলর রতন মালাকারের বক্তব্য, এমন কোনও অভিযোগ তিনি পাননি। তবে রতনবাবুরও অনুমান, অভিযোগ ভিত্তিহীন। “আমার মনে হয় না, ওই জমির মধ্যে দিয়ে অন্য কোথাও জলের লাইন দেওয়া হয়েছে। সেখানে নতুন নিকাশি নালাও তৈরি হয়নি।” পর্যবেক্ষণ পুর-প্রতিনিধির। পুরকর্তারা জানিয়েছেন, কোনও বাড়িতে জলের লাইন ঠিক কোথা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার নকশা পুরসভার কাছে থাকে না। স্থানীয় সূত্রে অবশ্য অভিযোগ মিলেছে, রাতের অন্ধকারে কিছু লোককে ভোলানাথবাবুর জমি খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেখা গিয়েছিল। বাবুনবাবুর বাড়িতে জলের সংযোগ তাঁর জমি দিয়ে গিয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখতে ২০১৩-র এপ্রিলে ওই ওয়ার্ডে জল সরবরাহ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকেও চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভোলানাথবাবু। পুরসভার স্থানীয় জল সরবরাহ দফতরের কর্তারা অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কলকাতা পুরসভার ওই বিভাগের উচ্চপদস্থ এক অফিসার শুধু বলেছেন, “জায়গাটি খুঁড়ে না-দেখলে কিছু বোঝা যাবে না।”
তবে ভোলানাথবাবুর অভিযোগ যাচাই করতে ওই জমিতে খোঁড়াখুঁড়ির কোনও পরিকল্পনা যে এখনই পুরসভার নেই, কর্তাদের কথাতেই তা স্পষ্ট। প্রশাসনের এ হেন অবস্থানের পিছনে রাজনৈতিক প্রভাবের ভূমিকাই দেখছেন ভোলানাথবাবু। বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়তো ওঁরা ভয় পাচ্ছেন। পাড়ার কোনও লোকও তাই আমার পাশে নেই।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন এলাকাবাসী অবশ্য একান্তে বলেছেন, “ওঁদের (মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকজন) হাতে পুলিশ, প্রশাসন রয়েছে। কে লড়তে যাবে ওঁদের সঙ্গে! আমাদের তো এখানেই থাকতে হবে।”
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকেও সাড়া না-পেয়ে ভোলানাথবাবু যারপরনাই ব্যথিত। তাঁর দাবি, প্রতিবেশী তো বটেই, তাঁর বোনের সহপাঠিনী হওয়ার সুবাদেও মমতাকে তিনি ছোটবেলা থেকে চেনেন। নিরাপত্তার কড়াকড়িতে মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি মুখোমুখি নালিশ জানাতে পারেননি। তাই পুরো ঘটনা জানিয়ে একাধিক চিঠি লিখেছেন। শপথগ্রহণের দশ দিন বাদে, ২০১১-র ৩০ মে তারিখে পাঠানো প্রথম চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘বোন’ সম্বোধন করে প্রৌঢ় লিখেছিলেন, ‘তুমি ক্ষমতার আসনে বসেছ। কিন্তু তোমার ভাই বাবুনকে শাসন করো। ও আমার ব্যবসার জায়গা তছনছ করে দিল! একটার পর একটা ঘর তুলছে! পুলিশ বাধা দিলে পুলিশকে ও বাধা দেয়! বাবুন জায়গাটা জবরদখল করতে চাইছে।’
কোনও ফল হয়নি। এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ও তাঁর তদানীন্তন মহাকরণের অফিসে চার বার চিঠি দিয়েছেন ভোলানাথবাবু। সেগুলির প্রাপ্তিস্বীকারের রসিদ তাঁর কাছে রয়েছে। সেখান থেকে কোনও সাড়া না-পেয়ে তিনি রাজভবনের দ্বারস্থ হন। ২০১১-র জুলাই ও ২০১৩-র জুনে রাজ্যপালকে চিঠি লিখে ভোলানাথবাবু আবেদন করেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে সাহায্য চেয়েছিলাম। না-পেয়ে আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন।’
রাজভবনের সাড়াও আসেনি। শেষমেশ গত ডিসেম্বরে তিনি বাবুনবাবুকেই চিঠি দেন। তাতে লেখেন, ‘তুমি মুখ্যমন্ত্রীর ভাই হয়ে এ সব করছ! এটা খুব নিন্দার বিষয়।’ বাবুনবাবু কি সে চিঠি পেয়েছেন?
এই সব চিঠি-চাপাটিকে ভোলানাথবাবুর ‘মানসিক সমস্যার’ বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই। বাবুনবাবুর কথায়, “আমার বদনাম করার জন্য উনি এমন পাগলামি করছেন। আমি চার দশক ধরে এখানে রয়েছি। কারও জমিতে কোনও কিছু করিনি। অথচ উনি একে-ওকে মিথ্যে নালিশ করেই যাচ্ছেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy