Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘জতুগৃহে’ অবাধে ব্যবসা, জেনেও হুঁশ নেই পুরসভার

সংকীর্ণ বোনফিল্ড লেনের দু’পাশে ঢাউস করা বস্তার স্তূপ। রাস্তার দু’পাশে বাতিস্তম্ভ থেকে ঝুলছে তারের কুণ্ডলী। পাকানো মুখ-কাটা অবস্থায় বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে বিদ্যুতের তারগুলি।

এ ভাবেই চলে বিকিকিনি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

এ ভাবেই চলে বিকিকিনি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

সুপ্রিয় তরফদার
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০২:৩৬
Share: Save:

সংকীর্ণ বোনফিল্ড লেনের দু’পাশে ঢাউস করা বস্তার স্তূপ। রাস্তার দু’পাশে বাতিস্তম্ভ থেকে ঝুলছে তারের কুণ্ডলী। পাকানো মুখ-কাটা অবস্থায় বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে বিদ্যুতের তারগুলি। তারই ঠিক নীচে ও আশপাশে সার দিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ও রঙের দোকান।

তার পাশ দিয়েই বেরিয়েছে একটি সরু গলি। সামনে রঙের দোকান, ভিতরে প্লাইউডের গুদাম। স্তূপাকৃতি প্লাইউডের মধ্যেই গোটা ঘরে ছড়িয়ে বিদ্যুতের তার। নেই একটিও অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র। অথচ খাস কলকাতার মধ্যে এ রকম বিপজ্জনক অবস্থাতেও দমকল থেকে পুরসভা— যেন হুঁশ নেই কারও। এবং কার্যত প্রায় মৃত্যুফাঁদের মধ্যেই দোকান চালাচ্ছেন চিনাবাজার, বোনফিল্ড লেনের প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্যবসায়ী। গোটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দাহ্য পদার্থ। ছড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক বিদ্যুতের তার থেকেও যে কোনও মুহূর্তে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুনের ফুলকি রাসায়নিক দ্রব্যে পড়লে আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা খোদ ব্যবসায়ীদেরই।

ওই বাজারের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবসায়ীদের সংগঠনের তরফে তপন দাঁ জানালেন, বাজারে মোট ৫০টি রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ও দোকান রয়েছে। স্টেশনারি, বাজি ও আবিরের দোকান রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। কিন্তু বেশিরভাগেরই ফায়ার সেফটি লাইসেন্স নবীকরণ করা নেই বলে জানালেন তপনবাবু। তাঁর অভিযোগ, প্রতি বছরই দমকলের ফায়ার সেফটি লাইসেন্স নবীকরণের জন্য টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু দমকল কোনও লাইসেন্স দেয় না। বার বার আবেদন করেও লাইসেন্স মেলে না বলে অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের একাংশের আরও অভিযোগ, কী ভাবে সব চলছে, তা খতিয়ে দেখার কোনও প্রয়োজনও মনে করে না দমকল।

এ ছাড়া এলাকাটি এতটাই সরু যে দমকলের গাড়িও ঢুকতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি কী হবে, তা নিয়েও আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। বোনফিল্ড লেনের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি। কখন যে কী হয়! দমকল তো কিছুই করে না।’’

একই অবস্থা পাগোয়াপট্টি ও চেতরাম কাটরা মার্কেটেরও। সেখানেও একই ভাবে ঘিঞ্জি বাড়ির মধ্যে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে বহু দোকান। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখেই বাঁ হাতে একের পর এক মিটার বক্স। কয়েকটির তারের জোড়া মুখ প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধা, যা আরও বিপজ্জনক। দমকলের ছাড়পত্র ছাড়া কী ভাবে এখানে ব্যবসা চলছে? সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি। দমকল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ফায়ার সেফটি লাইসেন্সের আবেদন করেন না। তাই অনেকের কাছেই লাইসেন্স নেই। নবীকরণ তো দূরের কথা। এক আধিকারিক জানান, দোকানগুলিতে জলের মজুতই নেই, রাস্তা সরু হওয়ার কারণে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ি ঢুকতেও সমস্যা হবে।

শহরের বিভিন্ন বাজারে বহু বার আগুন লেগেছে। সিটি মার্ট, নিউ মার্কেট-সহ শহরের একাধিক বাজার কার্যত জতুগৃহ হয়ে রয়েছে। আগুন লাগার পরেই দমকল ও পুরসভার নজরদারি চোখে পড়ে। কিন্তু তার পরেই সব যেন থিতিয়ে যায়। কোনও দুর্ঘটনা হওয়ার আগে দমকল বা পুরসভার নজরদারিই থাকে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। আট বছর আগে নন্দরাম মার্কেটের আগুন থেকে এখনও শিক্ষা নেয়নি বড়বাজার। দমকলের ছাড়পত্র ছাড়া কী ভাবে পুরসভা বড়বাজার এলাকায় ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেন?

কলকাতা পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে, যে সমস্ত ব্যবসায়ী দাহ্য পদার্থ নিয়ে ব্যবসা করেন তাঁদের ক্ষেত্রে দমকলের ছাড়পত্র থাকতে হবে। সেই ছা়ড়পত্র যতক্ষণ না পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পুরসভা লাইসেন্স নবীকরণ করতে পারে না। তবে দাহ্য পদার্থ ব্যতীত অন্য কোনও দ্রব্যের ক্ষেত্রে দমকলের ছাড়পত্র না থাকলেও চলবে। পুরসভার লাইসেন্স দফতরের এক আধিকারিক জানান, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, অন্য জিনিসের জন্য লাইসেন্স নিয়ে পরে সেখানেই নিয়ম লঙ্ঘন করে দাহ্য বস্তু রেখে দমকলের ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যবসা চলছে। এই ধরনের কোনও ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করতে পারলে তাঁর লাইসেন্স নবীকরণ করা হয় না বলে জানিয়েছে পুর প্রশাসন।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের পরে পুরসভা, দমকল দফতর, সিইএসসি এবং পুলিশ বড়বাজার এলাকার বিভিন্ন বাড়ি, বাজার পরিদর্শন করে ব্যবসায়ীদের অগ্নি-নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কয়েকটি জায়গায় তা করা হলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই অধরা রয়ে গিয়েছে। দমকলের বক্তব্য, যাঁরা নির্দেশ মানেননি, তাঁদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এর পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বড়বাজার এলাকার ফায়ার সেফটির জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছি। শীঘ্রই তা প্রয়োগ করা হতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Burrabazar Kolkata Corporation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE