Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সব আতঙ্কেরই তো একটা শেষ থাকে!

অপমানে জর্জরিত মুসলিমরা তাই এ বার তাঁদের সহনাগরিকদের সঙ্গে পথে নেমে জানান দিচ্ছেন, তাঁরা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন।

প্রতিবাদ: শহরের পথে নাগরিক মিছিলে বিক্ষোভকারীরা। নিজস্ব চিত্র

প্রতিবাদ: শহরের পথে নাগরিক মিছিলে বিক্ষোভকারীরা। নিজস্ব চিত্র

আফরোজা খাতুন
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪৪
Share: Save:

মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে— শহরে নয়া নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জি বিরোধী মিছিলের জনসমুদ্র তা-ই বুঝিয়ে দিয়েছে।

নয়া নাগরিকত্ব আইনের ফলে ভিটেমাটি হারানোর আতঙ্কে ভুগছে সকলেই। বাঁকুড়া থেকে প্রায়ই ফোন করে ইদ মহম্মদ ভাই বলছেন, ‘‘দিদি কী কী কাগজ জোগাড় করব? আমার স্কুল সার্টিফিকেট নেই, পৈতৃক সম্পত্তিও নেই। আমি যে এ দেশেরই মানুষ, তা প্রমাণ করতে হবে যে!’’ এই আতঙ্ক একা ইদ মহম্মদের নয়। মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে খবর পেলাম, প্রতিবেশীরা বাক্স-প্যাঁটরা ঝেড়ে বাবা-দাদুর আমলের কাগজ খুঁজছেন হন্যে হয়ে। ৬৮ বছরের বৃদ্ধা মনে করতে পারছেন না, কোন ক্লাস ও কোন বছর পর্যন্ত স্কুলে পড়েছিলেন। উপায় না দেখে শেষে সকলকে অনুরোধ করছেন, কেউ যদি স্কুল থেকে তাঁর সার্টিফিকেট বার করিয়ে দেয়। বিজেপি সরকারের কাছে এ দেশের নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে মুসলিম নাগরিকদের, তা এত দিনে টের পেয়েছেন তাঁরা। আর এই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করাতেই যেন সরকার ও তার দলের সাফল্য।

তবে সব আতঙ্কেরই তো একটা শেষ থাকে! অপমানে জর্জরিত মুসলিমরা তাই এ বার তাঁদের সহনাগরিকদের সঙ্গে পথে নেমে জানান দিচ্ছেন, তাঁরা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন। সংগ্রামে এবং শ্রমে দেশকে স্বাধীন করার শরিক তাঁরাও। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারিগর তাঁরাও। তাই দেশের ভাঙন রোধে আজ সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধের রাস্তাই বেছে নিয়েছেন তাঁরা।

কোনও একটি সম্প্রদায়কে সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সংগঠিত শক্তি প্রতিবাদ করবে— এটাই ইতিহাস, এটাই বাস্তব। তবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে কেউই যে এই নতুন নাগরিকত্ব আইনের ফাঁদ থেকে রেহাই পাবে না, তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অসমের ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে রয়েছেন। তাই বিজেপি সরকারের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন এত দিন ধরে নীরব থাকা সংখ্যাগুরুরাও। তাঁরাও আজ পথে।

কিন্তু প্রতিবাদী স্বরকে স্তব্ধ করতে পোশাকের ভিত্তিতে চিহ্নিতকরণের পথে যাচ্ছে বিজেপি সরকার। প্রতিবাদের ধরন ধ্বংসাত্মক মনে হলেই প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভকারীর পোশাক দেখে তাঁকে মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করছেন। দেশে বিদ্বেষ তৈরি করে এ ভাবেই সম্প্রীতি ধ্বংসের বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি তাঁর দলের সমর্থকদের চরম উৎসাহ দিয়েছে। তাই মানুষের মিছিলে তাঁদের চোখ আজ লুঙ্গি, টুপি খুঁজে ফেরে।

সম্প্রতি সুলেখার মোড়ে বিজেপির পথ অবরোধে আটকে পড়েছিল বাচ্চাদের স্কুল বাস। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক মহিলা বলেন, ‘‘স্কুল বাস আটকে যাওয়ার জন্য প্রশ্ন তুলছেন? আর লুঙ্গি পরা লোকেরা যে ট্রেন পুড়িয়ে দিচ্ছে, তা দেখতে পান না?’’ টিভি চ্যানেলে বিতর্কের আসরে বিজেপির নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে বিজেপির রাজ্য সভাপতি, সকলেই এখন ‘লুঙ্গি সংস্কৃতি’ শব্দটি প্রচার করে পোশাকের নামে বিভেদ তৈরির চেষ্টায় রয়েছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ক্রমাগত আঘাতের প্রত্যুত্তরেই তাই পথে নেমেছে মানুষ। মিছিল পরিণত হয়েছে জনজোয়ারে।

সীমাহীন ঔদ্ধত্যে বিভাজন করার মধ্যেই রয়েছে সত্য গোপনের চেষ্টা। বিভেদের রাজনীতি, ধর্মের নামে সংঘর্ষের পরিবেশ শুধু শাসকের স্বার্থকেই চরিতার্থ করতে পারে। বিভাজন দিয়ে মানুষের মৌলিক দাবিও পূরণ হয় না। দেশে এখনও হাজার হাজার বেকার, প্রতিদিন চাকরি যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থ লুট করে কিছু মানুষ বিদেশে পালাচ্ছে। এত কিছু ‘নেই’কে আড়াল করতেই ধর্মের নামে ভেদাভেদের চেষ্টা হচ্ছে। যার বিষাক্ত প্রকাশ মানুষে মানুষে হানাহানি। এ তো শাসকের প্রয়োজনে তৈরি! সাধারণ মানুষের কী লাভ? মানুষকে ঘৃণা করে, দূরে ঠেলে কি সংসারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা সুখ আসে? আসা কি সম্ভব?

কারও নাগরিকত্ব প্রমাণে কোন তথ্যটা প্রয়োজন, তা এখনও সরকার জানায়নি। নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ যে ভোটার কার্ড দেখিয়ে ভোট দিয়ে কোনও ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন, সেই কার্ড চলবে না। আধার কার্ডও গ্রহণযোগ্য নয়। তা হলে গভীর এই আঁধারে দাঁড়িয়ে ধর্মভেদ কেন? হাতে হাত ধরে কি এই আঁধার দূর করা যায় না? বেঁচে থাকার রসদ যে ভালবাসার বন্ধনেই।

(লেখক সমাজকর্মী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Muslim CAA NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE