Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ ইন্টারনেট-ই খুলে দিল মাঠের পথ

আগে একটি দলই যেখানে গড়া যেত না, সেখানে ২২ জন মিলে দুটো দল গড়ে সবাইকে ক্রিকেট খেলতে সুযোগ দিতে হচ্ছে।

ময়দানে কিশোর-যুবকদের ক্রিকেট। —ফাইল চিত্র

ময়দানে কিশোর-যুবকদের ক্রিকেট। —ফাইল চিত্র

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:০৫
Share: Save:

এক সময়ে দিনের বেলা স্কুল-কলেজ, পড়াশোনা থাকত। তাই ভোর থেকেই মাঠে মাঠে শুরু হয়ে যেত ক্রিকেট, ফুটবল। কিন্তু আজকাল খেলা তো দূরের কথা, টুর্নামেন্টে লড়ার জন্য ১১ জনের দল গড়াই মুশকিল হয়ে যায়। কারও শরীর ম্যাজম্যাজ করে তো কেউ ভোরে ঘুম থেকে উঠতেই পারে না।

কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে সব কিছু যেন রাতারাতিই বদলে গিয়েছে। ভোর হতেই খেলার জন্য ছেলেরা চলে আসছে মাঠে। আগে একটি দলই যেখানে গড়া যেত না, সেখানে ২২ জন মিলে দুটো দল গড়ে সবাইকে ক্রিকেট খেলতে সুযোগ দিতে হচ্ছে।

এক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেট পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছিল দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়ায়। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় বিক্ষোভ আর গোলমাল চলছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে এ রাজ্যেও। সেই কারণেই গুজব ও ভুয়ো খবর ছড়ানো আটকাতে রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছে সরকার। তাতে প্রবল অসুবিধায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ গিয়েছে থমকে। কাউকে কোনও নথি পাঠানো, ইমেল করা, ক্যাব বুক করা বা মোবাইল অ্যাপে খাবার আনানো থেকে অনলাইনে পড়াশোনা, সবই বন্ধ।

এই ঘটনায় সব চেয়ে বেশি মনমরা হয়ে রয়েছে স্কুল ও কলেজপড়ুয়ারা। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার থেকে শুরু করে অনলাইন গেম, ইউটিউব— সব বন্ধ। কিছু সার্চ করলেই গোল গোল হয়ে ঘুরে চলেছে গুগল। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলেই চলে আসছে মেসেজ, ‘বিশেষ কারণে এই এলাকায় নেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।’ পুলিশ, প্রশাসনের কাছে আসছে ঘনঘন ফোন— ‘কাকু নেট কবে চালু হবে?’

বারাসতের বাসিন্দা শুভ ভৌমিক বললেন, ‘‘পড়াশোনার শেষে বেশি রাত পর্যন্ত অনলাইনে গেম খেলতাম, চ্যাট করতাম। ওয়েব সিরিজ়ও দেখতাম। তাই সকালে উঠতে পারতাম না। এখন তো মোবাইলে কিছুই করার নেই। তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে উঠেও পড়ছি। ফোনটা দেখে এখন রাগই হয়। ও সব ফেলে আগের মতো খেলতে চলে আসি।’’

স্টেডিয়াম তো বটেই, বারাসতের কাছারি ময়দান, পায়োনিয়ার ও সুভাষ মাঠে এখন সকালে ভিড় বাড়ছে শুভর মতো অনেকেরই। শিশুমঙ্গল মাঠে দাঁড়িয়ে শিবশঙ্কর বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক জন বলেন, ‘‘কী অবস্থা! নেট নেই বলে মাঠে ভিড়। ভাবা যায়! কাকে ছেড়ে কাকে দলে নেব, ঠিক করতে পারছি না। জিমেও সবার মুখে একই কথা। কী করে ফেলেছে এই নেট!’’

‘‘এটাকে বলে, ফোর্সড ডিটক্সিফিকেশন অব ইন্টারনেট অ্যাডিকশন,’’ বলছিলেন ‘সার্ক ফেডারেশন অব সাইকায়াট্রি’র সহ-সভাপতি গৌতম সাহা। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে নেট বন্ধ থাকায় মোবাইলের প্রতি আসক্তি থেকে বাধ্য হয়েই বেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেককে। এখন সময় কাটাতে খেলার মাঠে ফিরেছে ওরা। ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারে ছাত্র ও যুব সমাজের শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। নেট পরিষেবা স্বাভাবিক হওয়ার পরেও যদি খেলাধুলোর এই অভ্যাস বজায় থাকে, তা হলে ভার্চুয়াল জগতের আসক্তি কাটিয়ে ওরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারবে।’’ অনেক দিন পরে লেখার জন্য খাতা-কলম আর তাক থেকে গল্পের বইও বেরিয়ে পড়েছে বহু বাড়িতে।

সম্প্রতি জন্মদিনের একটি পার্টি চলছিল দক্ষিণ শহরতলির কামালগাজির এক আবাসনে। ইউটিউবে যেমন খুশি গান চালানোর উপায় নেই। অগত্যা ভরসা মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখা গান। সবাইকে নিয়ে নিজস্বী তুলছিলেন কেয়া দাস নামে এক তরুণী। যাঁর জন্মদিন, সেই অস্মিতা মণ্ডল বললেন, ‘‘ধুস, কী হবে ছবি তুলে? দিবি কোথায়? নেটই তো নেই!’’ গোমড়া মুখে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যান সবাই। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডার পরে অস্মিতার বন্ধু শুভন নামে এক যুবক বললেন, ‘‘একটা জিনিস খেয়াল করলি? অনেক দিন পরে কিন্তু এত ভাল আড্ডা হল। নেট থাকলে তো সবাই মোবাইলেই ঘাড় গুঁজে থাকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CAA NRC Internet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE