বাইপাসের একটি বিপণিতে জংলা প্রিন্টের পোশাক। নিজস্ব চিত্র
গত কয়েক দিন সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই এক কলেজপড়ুয়ার ‘ওয়ালে’ ঘুরপাক খাচ্ছিল একের পর এক ‘ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টে’র পোশাকের বিজ্ঞাপন। ট্রাউজার্স, শার্ট, টুপি— এমনকি মোজাও ওই রঙের!
খানিক বিভ্রান্ত ওই পড়ুয়া দেখেন, দিন দশেক আগে একটি পোশাক-বিপণি সংস্থার অ্যাপে ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের একটি ট্রাউজার্স ‘উইশ লিস্টে’ তুলেছিলেন তিনি। তার পর থেকেই তাঁর সোশ্যাল সাইটের দখল নেয় ওই ধরনের পোশাকের বিজ্ঞাপন। ওই পড়ুয়ার কথায়, ‘‘সে সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনিই ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, তার মধ্যেই আমার অ্যাকাউন্টের ওই হাল! দেখলে মনে হয়, যেন দেশাত্মবোধ উথলে উঠছে।’’
পোশাক-বিপণির সঙ্গে যুক্তেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, গত এক মাসে হঠাৎ করেই চাহিদা বেড়ে গিয়েছে ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের পোশাকের। গাঢ় সবুজ, খয়েরি রঙের ওই ধরনের প্রিন্টের পোশাক কিনতে শপিং মল, অনলাইন বিপণি-সাইট চষে ফেলছেন কেউ কেউ। গত এক মাসে ভারতের একটি অনলাইন বিপণির অ্যাপে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ গ্রাহক ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের পোশাককে ‘উইশ লিস্ট’-এ তুলেছেন বলে খবর। একই ‘ট্রেন্ড’ দেখা গিয়েছে অন্য আর একটি বহুজাতিক অনলাইন বিপণি সংস্থার অ্যাপেও। ওয়াশিংটনে প্রধান কার্যালয় থাকা ওই সংস্থার আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের অ্যাপ ব্যবহার করে গত ২০ দিনে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি বার ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের পোশাক সার্চ করা হয়েছে। ওই ধরনের পোশাকের বরাতও দেওয়া হয়েছে অহরহ।
রবিবার দুপুরেই বন্ধুর সঙ্গে ইএম বাইপাসের একটি পোশাক-বিপণিতে গিয়েছিলেন আশুতোষ কলেজের পড়ুয়া স্নেহা দত্ত। ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের একটি শার্ট নিয়ে সঙ্গীকে বললেন, ‘‘অনলাইনেও দেখছিলাম। একটা নেব!’’ হঠাৎ এই প্রিন্ট কেন? স্নেহার জবাব, ‘‘এখন ফ্যাশনে খুব ট্রেন্ডি।’’ দোকানের কাউন্টারে বসা সুব্রত সাহা অবশ্য বললেন, ‘‘এই প্রিন্টের এখন খুব চাহিদা।’’ সল্টলেকের এক শপিং মলে আবার খোঁজ করে জানা গেল, এই প্রিন্টের একাধিক পোশাক এসেছে তাঁদের মুম্বইয়ের প্রধান কার্যালয় থেকে।
ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল বলছেন, ‘‘ক্যামোফ্লাজ প্রিন্ট ঘুরেফিরে আসে। এখন ওই প্রিন্ট আরও ট্রেন্ডি। সকলেই এই ধরনের রং পরতে চাইছেন। আসলে দেশের পাশে থাকার বার্তা। আমিও মেয়েদের জন্য এই ধরনের প্রিন্ট নিয়ে কাজ করা যায় কি না ভাবছি।’’ সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ‘‘এ অনেকটা দেশের জার্সি পরে দেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার মতো। দেশের জার্সি যদি না-ও থাকে, ওই জার্সির রঙেরই কোনও পোশাক পরে খেলা দেখতে বসি আমরা। আদতে আমরা দেশের সঙ্গে রয়েছি, এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘দেশের শক্তি উদ্যাপনের এক ধরনের গরিমাও রয়েছে এতে।’’
কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞেরা যদিও বলছেন, আদতে এটা এক ধরনের ‘কাল্টিভেশন’ পদ্ধতি। সমসাময়িক পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খাদ্যাভ্যাস, চুলের ছাঁট, পোশাক বদলে যাওয়ার বহু উদাহরণ আছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের হাতে আটক হয়ে পরে মুক্ত বায়ুসেনা কর্মীর মতো গোঁফের ছাঁটও চর্চায় রয়েছে। তবে মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব মনে করছেন, ‘‘অনেকে ভাবেন, এই ধরনের পোশাক কিনলে দেশাত্মবোধ প্রকাশ করা যায়। তবে তা কতটা ভিতর থেকে আসা, সেটাও ভাবা দরকার।’’
ধর্মতলায় এক শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক শোনাচ্ছিলেন ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের ট্রাউজার্স কিনে তাঁর বিড়ম্বনার কথা। বললেন, ‘‘কর্পোরেট সংস্থায় কাজ করি। প্রথম দিন অফিসে ওই ধরনের পোশাক পরে যেতেই বসের বকুনি খেতে হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেসা করেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছ?’’
তার পর থেকে ওই ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের ট্রাউজার্স আলমারিতেই বন্দি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy