Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

হাসপাতালেই ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের স্কুল

কলকাতার তিন সরকারি হাসপাতালে মূলত ক্যানসার-আক্রান্ত শিশুদের ওয়ার্ডেই পড়ানো, চিকিৎসা শেষে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা, কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে পড়াশোনা চালানোর বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে।

লেখাপড়া: এনআরএসে ওয়ার্ডের মধ্যেই চলছে ক্লাস। —নিজস্ব চিত্র।

লেখাপড়া: এনআরএসে ওয়ার্ডের মধ্যেই চলছে ক্লাস। —নিজস্ব চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

হাসপাতালের সার-সার শয্যার মাঝে মাটিতে মাদুর পাতা। বই-খাতা, পেনসিল বাক্স, রঙের বাক্স নিয়ে গোল করে বসে নার্গিস, বাপি, আঞ্জোয়ান, আদর্শ, সৃজনীরা। মাঝখানে বসে পড়াচ্ছেন পদ্ম দিদিমনি।

কেমোথেরাপির জেরে নার্গিসদের চুল উঠে গিয়েছে, শরীর ফ্যাকাসে, হাতের স্যালাইনের চ্যানেলে যন্ত্রণা আর কমে না। খাবার বিস্বাদ, মাস গড়িয়ে যায় হাসপাতালের চার দেওয়ালে আটকে। এর মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে পাওয়া এই ‘ওয়ার্ড স্কুল।’ সেখানে ফের চলে এক সঙ্গে কবিতা শেখা, নামতা আওড়ানো, বানান শেখা। দিনের এই সময়টুকু অদ্ভুত এক জিয়নকাঠিতে বাচ্চাগুলোর সব অসুখ যেন সেরে যায়। বাবা-মায়েদেরও মনে হয়, সব ফুরিয়ে যায়নি। জীবনের মূল স্রোতে ফেরারই প্রস্তুতি চালাচ্ছে বাচ্চারা, তাদের ওয়ার্ড-স্কুলে।

কলকাতার তিন সরকারি হাসপাতালে মূলত ক্যানসার-আক্রান্ত শিশুদের ওয়ার্ডেই পড়ানো, চিকিৎসা শেষে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা, কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে পড়াশোনা চালানোর বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে মউ সই করে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং এসএসকেএম হাসপাতালে এই কাজ করছে দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। পড়ার জায়গা দেয় স্বাস্থ্য দফতর। বই-খাতা-পেনসিল-শিক্ষক সব নিখরচায় দেয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০১৭-১৮ সালে এনআরএস-এ মোট ৬৯৮ জন ক্যানসার আক্রান্ত-শিশু ওয়ার্ডেই নিয়মিত পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৯১টি শিশু ও এসএসকেএমে ৩৬টি শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় এনে চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরে ফের স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন হাসপাতাল মিলিয়ে বৃত্তি পেয়েছে ৯ জন শিশু-কিশোর।

সংস্থার তরফে পুনম বাগাই বলেন, ‘‘ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য মাসের পর মাস হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয় বলে স্কুল, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এসে অবসাদে তলিয়ে যেতে থাকে শিশুরা। পড়াশোনা যতটুকু জানত তা-ও ভুলতে বসে। আমরা চেয়েছিলাম, শিশুদের পড়া-লেখা-জানা যেন চলতে থাকে।’’ এই একই উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য দফতরও ওই সংস্থার দেওয়া প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী।

নীলরতনের হেমোটোলজি বিভাগে শিশু-ক্যানসার রোগীদের শয্যার পাশে দেওয়াল-জোড়া প্রজাপতির জীবনচক্র, ফুলের অভ্যন্তরীণ অংশের চার্ট। তার পাশেই আঁকা গাছের জীবনচক্র, সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ, সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত। চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী জানালেন, শুধু পড়াশোনার চর্চা রাখাই নয়, চিকিৎসা শেষে শিশুদের পুনর্বাসনে বড় ভূমিকা নেওয়া হয় এই কর্মসূচিতে। তিনি জানালেন, ক্যানিং থেকে বিশ্বজিৎ বাইন নামে তেরো বছরের এক কিশোর এসেছিল। ক্লাস সেভেনে প্রথম হত। দু’বছর চিকিৎসার পরে যখন বাড়ি গেল তখন বন্ধুরা উঁচু ক্লাসে উঠে গিয়েছে। মুখচোরা সেই ছেলে কিছুতেই আর স্কুলে যাবে না। তার ও তার স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে টানা কথা বলে, কাউন্সেলিং করে স্কুলে ফিরিয়েছিলেন হাসপাতালের ওয়ার্ড স্কুলের দিদিমণিরাই।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ‘বেডসাইড স্কুল’-এর দিদিমণি আরাত্রিকা জানালেন, নদিয়া থেকে ভবানী বর্মণ (১৭) নামে এক কিশোরী এসেছিলেন। চারটি কেমো নেওয়ার পরে সে সাময়িক অন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি কারও সঙ্গে কথা বলত না। তখন হাসপাতাল-স্কুলের দিদিমণিরা তার কাউন্সেলিং করেন, পড়ানো শুরু করেন। কিশোরী ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরে পায়। তাঁকে বিএড-এ ভর্তি করা হয় এবং মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়।

এসএসকেএমের বেডসাইড স্কুলের দিদিমণি স্বাগতাও জানাচ্ছিলেন, মেন বিল্ডিংয়ে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের নিয়ে তাঁরা কাজ করেন। ক্যানসারের পাশাপাশি জটিল রোগ নিয়ে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি শিশুরাও নিয়মিত পড়তে আসে। তাঁর কথায়, ‘‘কিছুক্ষণের জন্য যন্ত্রণা, ওষুধ, কেমো ভুলিয়ে স্বাভাবিক জীবনের ছোঁয়া এনে দেয় এই স্কুল।’’ দিদিমণিদের অভিজ্ঞতায়, অনেক সময় সুস্থ হওয়ার পরে স্কুল এই ছেলেমেয়েদের নিতে চায় না। একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে যে, অন্য ছাত্রছাত্রীরা রোগাক্রান্ত হতে পারে। স্কুলকে বোঝাতে হয়।

তখনই পাশের শয্যা থেকে বীরভূমের মারগ্রামের বাসিন্দা কুর্নাহার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বাপি প্রামাণিক উজ্জ্বল চোখ নিয়ে বলে, ‘‘হাসপাতালে পড়াশোনার মধ্যে থাকলে মনে হয় যেন এখানেই মরবো না। ফের বাড়ি ফিরব, সুস্থ হব, স্কুলে যাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cancer Study School Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE