মঞ্চে স্বাধীনতা দিবস পালনে বন্দিরা। ফাইল চিত্র
স্বাধীনতা দিবস আবার কী! প্যারেড, জয় হিন্দ আর মিষ্টি বিতরণ। অফিসের সেই আড্ডাটাই তো নেই।
জেলের বন্দিদের স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রসঙ্গ উঠতেই এমন কথাও এল আলোচনায়। সে সব গল্পেই ধরা পড়ল কী ভাবে একটু করে বদলেছে এই দিনটির অভিজ্ঞতা। ২০০০ সালের পর থেকে জেলের নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বদলাতে থাকে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের চেহারা। জাঁকজমক বাড়ে। এ বার আলিপুরে ঢোলে বোল ফোটাবেন বন্দি বাদল মুখোপাধ্যায়। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে এ বছর দেড় থেকে দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠানে গান, আবৃত্তি ছাড়াও থাকছে মার্শাল আর্টের উপরে নৃত্য। তবে ১৮ বছর পরে এ সব আয়োজনও গতানুগতিক হয়ে গিয়েছে অনেকের কাছে।
কারা দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকেও হত। কিন্তু এত সংগঠিত ছিল না। এখন প্রতিটি জেলে বন্দিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল আছে। নাটক, আবৃত্তি, গান, নাচ তাঁরাই করেন।’’ এখনকার অনুষ্ঠান একেবারেই আলাদা। ২০০৯-এ স্বাধীনতা দিবসে এক বন্দির কাবুলিওয়ালার অভিনয় মনে পড়ে কারাকর্তার। ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘বন্দিদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক সত্ত্বা থাকতে পারে, আগে কোনও দিন ভাবিনি।’’ পনেরো বছর আগে কৃষ্ণনগর জেলে বন্দি মাস্টারমশাই কেমন বক্তৃতা করেছিলেন, তা এখনও তরতাজা কারা দফতরের আর এক আধিকারিকের মনে। জেলের বন্দিদের নিয়ে কাজ করা নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায় বলেন, ‘‘জেলের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন একটা ধারা মেনেই চলছে। তবে সেই ধারায় যাঁদের উত্তরণ ঘটছে, তাঁদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিই আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ।’’
ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বলেন, ‘‘পঞ্চাশের দশকে স্বাধীনতা দিবসে বন্দিদের নিয়ে মাতামাতি হতো না। পতাকা উত্তোলনের পরে অপেক্ষাকৃত ভাল খাবার দেওয়া হতো, এই যা। সেই সময় স্লোগান উঠত, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হোক। আশি, নব্বইয়ের দশকেও এই স্লোগান উঠেছে। জেলে ১৫ অগস্টের তাৎপর্য হচ্ছে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া। সেটা কি হচ্ছে? রাজবন্দিদের রেখে জেলে স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে আমার কাছে এটাই একটা প্রহসন।’’
তবে অনুষ্ঠানের চেহারা যে আগে অনেকটাই আলাদা ছিল, সে কথা ধরা পড়ে সত্তরের দশকের রাজনৈতিক বন্দিদের কথাতেও। তাঁদেরই এক জন বলেন, ‘‘৬৮-৬৯ সালে দমদমে প্রথম জেলের ভিতরে স্বাধীনতা দিবসের অভিজ্ঞতা। দেখলাম, সকালে বন্দিরা জড়ো হয়ে পতাকা উত্তোলন করার পরে মিষ্টি-টিষ্টি বিলি হল। দুপুরে মাংস-ভাত হয়েছিল!’’ মেদিনীপুর জেলে থাকা এক রাজনৈতিক বন্দি বলেন, ‘‘১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ১৫ অগস্ট জেলে কেটেছে। আমাদের সময়ে প্রভাত ফেরি হত। তবে এখন যে ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তা হত না।’’ বদলটা অবশ্য এক দিনে আসেনি। কারাকর্তাদের কথাতেই উঠে আসে, নব্বইয়ের দশকেই কিছু কিছু পরিবর্তন হতে থাকে জেলের উদ্যাপনে। স্বাধীনতা দিবসে এক বার এসেছিলেন টিভি-র ধারাবাহিকের এক নামী সঙ্গীত পরিচালক। আর এক বার এসেছিল ছৌ নাচের দল।
তবু জেলে সত্তর-আশির দশকের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনই ভাল ছিল বলে মত এক কারা কর্তার। তাঁর কথায়, ‘‘তখন স্বাধীনতা দিবসে জেলের মেজাজটা বেশ ফুরফুরে থাকত। পতাকা উত্তোলনের পরে বন্দি, স্টাফ সকলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে গান-টান হওয়ার পরে অফিস ঘরে কত রকমের আলোচনা হত। কী ভাবে সারাদিন কাটল, তা ভেবেই হাসিমুখে বাড়ি ফিরতাম। এখন জঙ্গি হানার ভয়ে ত্রস্ত থাকতে হয়! সুপারদের এখন খুব চাপ।’’ আয়োজন যত বেড়েছে, বেড়েছে ততই কাজের চাপ। এ বছর প্রেসিডেন্সিতে ১৫ অগস্টে শুরু হচ্ছে সেভেন সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট। কৃষ্ণনগরে যেতে পারেন কারামন্ত্রী। কারা দফতরের ব্যস্ততার আরও নানা দিক এ ভাবেই ধরা পড়তে শুরু করে স্বাধীনতা দিবসের ফ্রেমে।
আর সে সময়ের মাংস-ভাতের চল কি এখনও রয়েছে?
১৯৯৭ সালে নেশার দায়ে আলিপুর সংশোধনাগারে কাটানো এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘দুপুরের খাওয়ায় কিন্তু বিশেষ মেনুর কথা মনে পড়ছে না।’’ মনে পড়ার কথাও নয়। কারা দফতরের কর্তাদের বক্তব্য অন্তত সে রকমই। এক কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের আলাদা করে কোনও তহবিল নেই। তাই বিশেষ দিনে মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল খেতে চাইলে তা অন্য দিনের বরাদ্দ থেকে কেটেই করা হবে। ধরুন সোমবার মাংস হওয়ার কথা। বুধবার যেহেতু স্বাধীনতা দিবস, তাই সোমবারের পরিবর্তে সে দিন মাংস হল।’’ পুরো গৃহস্থের হেঁসেলের ফর্মুলা। অর্থাৎ, সেই ব্যবস্থাপনার চিন্তাও থাকে কারাকর্তাদের।
ওই যে, স্বাধীনতা উদ্যাপনে এক-এক জন এক-এক
জায়গায় দাঁড়িয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy