অব্যাহত: শহরের তাপমাত্রা চড়লেও ময়দানে চলছে ক্রিকেটের অনুশীলন। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
হাওয়ায় ক্যাচ উঠেছে। বলে চোখ রেখে কিছু দূর ছুটেও নাগাল পেলেন না ফিল্ডার। কাছাকাছি পৌঁছেও ক্যাচ ছেড়ে দিয়ে মাথা মাটির দিকে করে শরীর ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে পা টেনে টেনে আরও কয়েক ধাপ এগোলেন তিনি। অবস্থা এমনই যে, থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছে। কিছুটা হেঁটেই হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়লেন। খেলা স্থগিত। জল, বরফ গায়ে ঘষে কিছুটা সুস্থ করার চেষ্টা হল। কিন্তু ওই ক্রিকেটারকে মাঠে ফেরানো গেল না! প্রবল বিরক্ত কোচ বললেন, ‘‘গরমে নেওয়া যাচ্ছে না। শরীর ছেড়ে দিয়েছে!’’
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই শহর কলকাতার গরম এমন ঊর্ধ্বমুখী যে, বেলা ১২টার পর থেকে রাস্তায় কয়েক পা হাঁটাও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া আপেক্ষিক আর্দ্রতার জেরে পাখার তলায় বসেও গলগল করে ঘাম হচ্ছে। গরমের এই চরম পরিস্থিতিতেও ময়দান জুড়ে চলছে ক্রিকেটের আসর। দুপুর রোদে বিভিন্ন ক্লাবের অনুশীলন তো বটেই, রয়েছে সিএবি-র নিজস্ব প্রতিযোগিতাও। ক্রিকেটারদের একটি বড় অংশই জানিয়েছেন, এই গরমে খেলতে গিয়ে কেউ মাঠে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও থাকে না। ইডেন গার্ডেন্স লাগোয়া ময়দানে কেউ অসুস্থ হলে তবু সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটের সাহায্য পাওয়া যায়। সিএবি-র অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শহরের অন্য মাঠগুলিতে সেই সুযোগও নেই। গত এক বছরে সোনু যাদব এবং অনিকেত শর্মা নামে দুই উঠতি ক্রিকেটারের মৃত্যু হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলে অভিযোগ।
বালিগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ দেবাশিস সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘গত ২৮ তারিখ এই গরমেই পার্ক সাইড রোডের মাঠে ম্যাচ ছিল আমাদের। দলের ক্যাপ্টেন হঠাৎ মাথা ঘুরে মাঠে পড়ে যান। কোনও মতে ওঁকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরানো গিয়েছে।’’ দেবাশিসবাবুরই ছাত্র ছিলেন উঠতি ক্রিকেটার সোনু। তাঁর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘এই গরমে ম্যাচ চলছে।
অথচ, মাঠে সামান্য চিকিৎসা পরিষেবাও থাকে না! সোনুর মৃত্যুর পরেও কিছু পাল্টায়নি। সিএবি থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে তার পরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই তো অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়।’’
হৃদ্রোগের চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বলছেন, ‘‘গরমে কাহিল হয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে প্রথম এক ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে বিপদ এড়ানো যায়। দেখতে হবে, ওই সময়টা যেন পেরিয়ে না যায়।’’ তাঁর পরামর্শ, গরমে ম্যাচ করতে হলে মাঠেই চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই বক্তব্য আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘এই প্রচণ্ড গরমে শরীর যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখতে হবে। গরমে খেলতে নামলে শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রায় গোলমাল হতে বাধ্য। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে ফল মারাত্মক হতে পারে।’’
তবু মাঠে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে না কেন? সিএবি-র এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘সব মাঠে, সব ম্যাচে চিকিৎসক বা অ্যাম্বুল্যান্স রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এত অ্যাম্বুল্যান্স বা চিকিৎসক কোথায়?’’
সিএবি-র যুগ্ম সচিব অভিষেক ডালমিয়া অবশ্য জানিয়েছেন, মাঠে এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে এখন পর্যবেক্ষক এবং আম্পায়ারদের ‘সিপিআর’ (কার্ডিয়ো-পালমোনারি রিসাসিটেশন)-এর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তাঁরা। সঙ্গে ক্রিকেটারদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষারও চিন্তাভাবনা রয়েছে তাঁদের। তিনি বলেন, ‘‘গরমের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ওয়ান-ডে লিগে পানীয়-বিরতির সময় বাড়ানো হয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য আমাদের কাছে সবার আগে।’’
ডালহৌসি স্পোর্টিং ক্লাবের তরফে কোচ অমন সিংহ বলছেন, ‘‘সিএবি চাইলে মাঠে চিকিৎসক রাখতে পারে। কিন্তু কলকাতার অন্য ক্লাবগুলির সেই সামর্থ্য কই?’’
অতএব, প্রখর তাপে মাঠে বিপদই সঙ্গী থাকছে খেলোয়াড়দের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy