Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের দিন হেনস্থা! সিপিএম এজেন্টের মৃতদেহ ঘিরে রহস্য

শনিবার বিধাননগর পুর-নির্বাচনের দিন কেবি কমিউনিটি সেন্টারে সিপিএমের পোলিং এজেন্ট ছিলেন উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় (৩১)। অভিযোগ, অচেনা যুবকের দল এসে চাপ তৈরি করে তাঁর উপরে। অপরিচিত যুবকেরা এসে ভোট দিয়ে যায়। প্রতিবাদ করায় উজ্জ্বলকে বার বার হুমকির মুখে পড়তে হয়।

উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।

উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ১২:১৩
Share: Save:

শনিবার বিধাননগর পুর-নির্বাচনের দিন কেবি কমিউনিটি সেন্টারে সিপিএমের পোলিং এজেন্ট ছিলেন উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় (৩১)। অভিযোগ, অচেনা যুবকের দল এসে চাপ তৈরি করে তাঁর উপরে। অপরিচিত যুবকেরা এসে ভোট দিয়ে যায়। প্রতিবাদ করায় উজ্জ্বলকে বার বার হুমকির মুখে পড়তে হয়। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বুথের ভিতরে থাকার পরে ‘খুনের হুমকির’ মুখে ভয় পেয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। অভিযোগ, বিকেলে তাঁকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়।

সেই উজ্জ্বলের দেহই রবিবার রাতে বিধাননগর থেকে কাঁকুরগাছির মাঝখানে রেল লাইনের ধারে পাওয়া গিয়েছে। উজ্জ্বল সল্টলেকের কেসি ব্লকের বাসিন্দা। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অস্থায়ী কর্মী। তাঁর মৃত্যুর কারণ নিছক দুর্ঘটনা নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, আগের দিন ও ভাবে হুমকির মুখে অপমানিত হয়ে কি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন উজ্জ্বল? কেবি-কেসি এলাকার সিপিএমের শাখা সম্পাদক শ্যামল ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, ‘‘উজ্জ্বলের মতো আমাকেও জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ৩০-৪০ জন যুবকের দল। আমি উজ্জ্বলকে বলেছিলাম, ‘চুপ করে সই করে দে।’ ও তাই-ই করেছিল।’’

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাতিপুকুর রেল লাইনের ধারে একই ভাবে এক যুবকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তিনি রিজওয়ানুর রহমান। যে মৃত্যুকে ঘিরে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। সিবিআইয়ের প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছিল, আত্মহত্যা করেছিলেন রিজওয়ান। সেই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল।

উজ্জ্বলের ক্ষেত্রে সেই একই প্রশ্ন তুলছেন আত্মীয়-বন্ধুদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ভোলাভালা গোছের উজ্জ্বল অজাতশত্রু। তাঁর বন্ধু ডিনা ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘এত সাদাসিধা একটা মানুষ। সবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার।’’ বন্ধুদের মতে, ওই ভাবে হুমকি দিয়ে, অপমান করে বুথ থেকে বার করে দেওয়ার ফলে সংবেদনশীল উজ্জ্বল ভিতরে ভিতরে হয়তো মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘যেরকম হুমকির কথা বলা হচ্ছে, তাতে ভিতরে ভিতের মারাত্মক ভয় পেয়ে থাকতে পারেন ওই যুবক। যেখান থেকে আত্মহত্যা করাটা অস্বাভাবিক নয়।’’ তাঁর দলের একাংশের অভিযোগ, উজ্জ্বলকে খুন করে রেললাইনের ধারে ফেলে রাখা হয়েছে কি না তাও পুলিশের খতিয়ে দেখা উচিত।

ঠিক কী হয়েছিল শনিবার?

সূত্রের খবর, কেবি কমিউনিটি সেন্টারে প্রথমে ইন্দ্রজিৎ রায় নামে এক এজেন্ট ছিলেন। এক ঘন্টার বেশি তিনি টিঁকতে পারেননি। দ্বিতীয় এজেন্ট হিসেবে নাম ছিল উজ্জ্বলের। তিনি আটটা নাগাদ ঢোকেন। সাড়ে আটটা নাগাদ বাইরে থেকে আসা যুবকদের আটকাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি শ্যামলবাবুকে ফোন করে বলেন, ‘‘প্রচন্ড চাপ এখানে। থাকাও যা, না থাকাও তা।’’ শ্যামলবাবু জানান, যতক্ষণ সম্ভব থাকতে। না পারলে বেরিয়ে আসতে। ওই ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী দিলীপ ভাদুড়ি এ দিন বলেন, ‘‘সাড়ে দশটায় আমায় ফোন করে একই কথা বলে। আমি সেখানে যাই। গিয়ে দেখি বুথের ভিতরে প্রচুর বাইরের ছেলে। উজ্জ্বল বলে, ‘দেখছেন তো কী অবস্থা। হুমকি দিচ্ছে। আমি কী করব?’ পুলিশকে বলে তাদের তখনকার মতো বার করে দেওয়া হয়। উজ্জ্বলকে বলে আসি, ‘আমরা তোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারব না। পারলে থাকবি, না পারলে বেরিয়ে যাবি।’’

শ্যামলবাবু জানান, আড়াইটা পর্যন্ত ওই বুথে ছিলেন উজ্জ্বল। তারপরে আর ভয়ঙ্কর সেই মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেননি। বুথ থেকে বেরিয়ে দূরে কয়েকজন নেতার কাছে বসেছিলেন। বাড়ি ফিরে যান পাঁচটা নাগাদ। এর পরে তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে আসেন কয়েকজন যুবক। তাঁরা তৃণমূলের স্থানীয় কর্মী। তুলে নিয়ে গিয়ে সই করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে কী চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন উজ্জ্বল?

উজ্জ্বলের মা ইলাদেবী জানান, ভোট শেষে বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে উজ্জ্বলের ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখতে পাননি। রবিবার সকালে আড্ডা মারতে বেরিয়েছিলেন। দুপুরে স্নান-খাওয়া করে বাবা কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের কর্মী উদয়বাবুর সঙ্গে দমদম ক্যান্টনমেন্টের নতুন কেনা ফ্ল্যাটে যান। কেসি-র ওই সরকারি আবাসন থেকে ফ্ল্যাটে বাড়ির জিনিসপত্র সরানো চলছিল। রবিবার সেই ফ্ল্যাটে পৌঁছোনর কিছু পরে উদয়বাবু যখন ফিরতে চান, তখন উজ্জ্বল জানান, তিনি কেবল-এর লোকের জন্য অপেক্ষা করবেন। জানান, সাড়ে সাতটা নাগাদ তিনি কেসি-র বাড়িতে ফিরে যাবেন। এ দিন ইলাদেবী বলেন, ‘‘সাড়ে আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরে আমরা বার বার করে ওর মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করি। দেখি মোবাইল বন্ধ করা রয়েছে।’’

রাতেই বিভিন্ন লোককে ফোন করতে শুরু করেন উদয়বাবু। এই সময়ে ফোনে তাঁদের ফ্ল্যাটের পূর্বতন মালিক স্বপন গুণ্ডি জানান, পুলিশের কাছ থেকে একটি ফোন তাঁর কাছে এসেছিল। রেললাইন থেকে একটি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেই ব্যক্তির পকেটে কার্ড ছিল স্বপনবাবুর। উদয়বাবুকে নিয়ে রাতেই বিধাননগর জিআরপিতে যান স্বপনবাবু। পরে ছেলের জিনিসপত্র এবং পুলিশের কাছে ছবি দেখে ছেলের দেহ শনাক্ত করেন উদয়বাবু। ছেলের ঘড়ি, আংটি, মানিব্যাগ পাওয়া গেলেও মোবাইল দু’টি পাওয়া যায়নি।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনে এসে বিধাননগর স্টেশনে নেমে যেতেন উদয়বাবু এবং উজ্জ্বল। অথচ উজ্জ্বলের দেহ পাওয়া গিয়েছে বিধাননগর ছাড়িয়ে কাঁকুরগাছির দিকে। উদয়বাবুর বক্তব্য, ওই এলাকায় উজ্জ্বলের যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না। তাঁর কথায়, ‘‘উজ্জ্বলের তো বিধাননগর নেমে বাস ধরার কথা ছিল। তা হলে কেন সে এতটা রাস্তা এগিয়ে গেল?’’ তাঁর অভিযোগ, বিষয়টিকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে জিআরপি তাঁকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি তা লেখেননি।

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে উজ্জ্বলের দেহ পাওয়া গিয়েছে, তাঁর দূরত্ব বিধাননগর স্টেশন থেকে হেঁটে ১৫ মিনিট। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাস-অটো পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, রাত ১০ টা নাগাদ তাঁরা ট্রেনে কিছু ধাক্কা লাগার শব্দ শোনেন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে বিধাননগর স্টেশনে খবর পাঠান। তাঁরা জানান, অনেক ট্রেন স্টেশনে না থেমে এগিয়ে সিগন্যালে থামলে অনেকেই ট্রেন থেকে ওখানে নেমে যান। উজ্জ্বলবাবুও তাই করেছিলেন কি না, তা অবশ্য কেউ দেখেননি।

সাধারণত, এই ধরণের ঘটনায় যে ট্রেনে ধাক্কা লেগেছে তার চালক বা গার্ড ওয়াকিটকি থেকে নিকটবর্তী কেবিনে খবর পাঠান। সে খবর আসে কন্ট্রোলে। যে ট্রেনে ধাক্কা লেগেছে সেই ট্রেনের চালক না বুঝতে পারলে পরের ট্রেনের চালক বা গার্ড দেখতে পেলে তাঁরা খবর পাঠান। কোনও না কোনও চালক বা গার্ডের নজরে আসার কথা রেল লাইনের পাশে পড়ে থাকা দেহ।

কিন্তু, উজ্জ্বলের ঘটনায় কোনও চালক বা গার্ড কন্ট্রোলে কোনও খবর পাঠাননি। যার জন্য পূর্ব রেলের কর্তা ব্যক্তিরা সঠিক করে বলতে পারেননি ঠিক কোন ট্রেনে ধাক্কা লেগেছে। উল্টে পূর্ব রেল সূত্রের খবর, বিধাননগর স্টেশনে পুলিশ খবর দেয় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। তিন ও চার নম্বর লাইনের মধ্যে একজন ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে পড়ে রয়েছেন।

চালক ও গার্ডদের নজর এড়িয়ে গেলেও পুলিশ এত তাড়াতাড়ি কী করে সেই ঘটনার কথা জানল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPIM municipal election left front salt lake
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE