Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
লেহ্-র দুর্ঘটনা

চোখের জলে বিদায়, পথে নেমে এল পাড়া

পাড়ায় যে খুব বেশি মেলামেশা ছিল, তেমন নয়। তবু সেই পরিবারের জন্য গোটা পাড়া ভিড় করেছে বিবেকানন্দ রোডের বাড়ির সামনে। নির্ধারিত সফরসূচি অনুযায়ী তাঁদের ফেরার কথা ছিল বুধবারেই। কিন্তু এ ভাবে তো নয়! আগেই খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল স্ত্রী-পুত্রের কফিনবন্দি দেহ নিয়ে লেহ্‌ থেকে বাড়ি ফিরছেন পদ্মনাভ বসু। তাঁরই অপেক্ষায় সন্ধ্যার কিছু আগে থেকে ভিড় জমতে শুরু করেছিল ওই এলাকায়। সন্ধ্যা যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে সেই ভিড়। পড়শিরা ছাড়াও শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন রাজশ্রীদেবী ও পদ্মনাভবাবুর সহকর্মী-বন্ধুরা। আসেন মন্ত্রী-নেতারাও। দাঁড়িয়ে যান অনেক পথচলতি মানুষ।

রাজশ্রীদেবী ও সৌম্যদীপের কফিনবন্দি দেহ এল বাড়িতে।

রাজশ্রীদেবী ও সৌম্যদীপের কফিনবন্দি দেহ এল বাড়িতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পাড়ায় যে খুব বেশি মেলামেশা ছিল, তেমন নয়। তবু সেই পরিবারের জন্য গোটা পাড়া ভিড় করেছে বিবেকানন্দ রোডের বাড়ির সামনে। নির্ধারিত সফরসূচি অনুযায়ী তাঁদের ফেরার কথা ছিল বুধবারেই। কিন্তু এ ভাবে তো নয়!

আগেই খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল স্ত্রী-পুত্রের কফিনবন্দি দেহ নিয়ে লেহ্‌ থেকে বাড়ি ফিরছেন পদ্মনাভ বসু। তাঁরই অপেক্ষায় সন্ধ্যার কিছু আগে থেকে ভিড় জমতে শুরু করেছিল ওই এলাকায়। সন্ধ্যা যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে সেই ভিড়। পড়শিরা ছাড়াও শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন রাজশ্রীদেবী ও পদ্মনাভবাবুর সহকর্মী-বন্ধুরা। আসেন মন্ত্রী-নেতারাও। দাঁড়িয়ে যান অনেক পথচলতি মানুষ।

রাত পৌনে ন’টা নাগাদ গাড়ি এসে থামে মানিকতলা এলাকার ওই বাড়ির সামনে। কয়েক জন আত্মীয়ের সঙ্গে গাড়ি থেকে নামেন পদ্মনাভবাবু। চেহারা কিছুটা উদ্‌ভ্রান্ত, তবে এত বড় ঝড়ের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই তাঁর আচরণে। চার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই সোজা ঢুকে যান বাড়ির ভিতরে। তাঁর পিছন পিছন ২৩২/এ বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে ঢুকিয়ে নেওয়া হয় দু’টি কফিন। তখন সেখানে উপস্থিত দুই মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে, অরূপ বিশ্বাস, বিধায়ক পরেশ পাল প্রমুখ।

বুধবার সকালে লেহ্-র জেলাশাসক সৌগত বিশ্বাস ফোনে বলেছিলেন, ‘‘মানসিক ভাবে ভীষণ শক্ত পদ্মনাভ বসু।’’ বুধবার সকালে স্ত্রী রাজশ্রী এবং একমাত্র সন্তান সৌম্যদীপের কফিনবন্দি দেহ নিয়ে একাই রওনা দেন লেহ্ থেকে, বিমানে। লেহ্-র জেলা প্রশাসনের অফিসারেরা বিমানবন্দর পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। দিল্লিতে পদ্মনাভবাবুর আত্মীয় এক সেনা অফিসার। লেহ্ থেকে বিমান পৌঁছলে দিল্লি বিমানবন্দরে তিনিই দেখা করেন পদ্মনাভবাবুর সঙ্গে। পরে এয়ার ইন্ডিয়ার সন্ধ্যার উড়ানে দু’টি কফিন নিয়ে কলকাতায় নামেন পদ্মনাভবাবু। সঙ্গে ছিলেন তাঁর আত্মীয় তারকনাথ মিত্র।

বাড়ির বাইরে ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন রাজশ্রীদেবীর ছাত্রছাত্রী-সহকর্মীরা। চলে এসেছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী। সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বেশির ভাগই। এক ছাত্রী বলেন, ‘‘আমাদের বিভাগ মা হারাল।’’

ভিড়ের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা চন্দনা সোম, নন্দিতা বসুরা। জানালেন, এই এলাকায় বহু বছরের বাসিন্দা হলেও পাড়ায় তেমন মেলামেশা করতেন না বসু পরিবারের কেউই। অধিকাংশ সময়ে পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকতেন পদ্মনাভ, রাজশ্রী ও সৌম্যদীপ। এমন একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারের এই রকম পরিণতিতে একেবারেই বাক্‌রুদ্ধ তাঁরা। ভেঙে পড়েছেন সৌম্যদীপের স্কুলের বন্ধুরাও। খবর পেয়ে দক্ষিণ কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলেন ইন্দ্রাশিস ভট্টাচার্য, সোহম ভৌমিক।

রাতে নিমতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশ্রী-সৌম্যদীপের দেহ। এই সময়ে যাতায়াতের জন্য আধ ঘণ্টার উপরে বন্ধ রাখা হয়েছিল বিবেকানন্দ রোড একটি দিক। যার জেরে প্রবল যানজট হয় ওই এলাকায়।

মানিকতলার বাসিন্দা, সাহা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী পদ্মনাভবাবু পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন লেহ্-তে। রওনা হয়েছিলেন ৩০ মে। গত সোমবার লেহ্ থেকে নুব্রা উপত্যকায় যাচ্ছিলেন। সোমবার সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ নুব্রা উপত্যকায় আচমকা তুষার ধসে চাপা পড়ে যায় পদ্মনাভবাবুদের গাড়ি। সেই গাড়িতে তাঁরা তিন জন ছাড়াও ছিলেন চালক আব্দুল হক। রাত ন’টা নাগাদ তাঁদের উদ্ধার করা যায়। প্রথমে সেনা শিবির ও পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি রাজশ্রীদেবী ও সৌম্যদীপকে। অসুস্থ অবস্থায় লেহ্-র সোনম নুরবু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল পদ্মনাভবাবু ও আব্দুলকে। মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে যান আব্দুল। পদ্মনাভবাবুও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

ওই হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়ংচ্যাম দোলমা বুধবার ফোনে জানান, মঙ্গলবার রাতেই লেহ্-র সেনা হাসপাতাল থেকে এক মহিলা চিকিৎসক কর্নেল কল্যাণী সোনম নুরবু হাসপাতালে আসেন। পরে সেনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পদ্মনাভবাবুকে। তাঁর আত্মীয় সেনা অফিসারই এই ব্যবস্থা করেন। রাতে সেখানেই স্ত্রী ও ছেলের মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হয় পদ্মনাভবাবুকে। দোলমা বলেন, ‘‘আমরা তাঁকে বলেই রেখেছিলাম, আপনার স্ত্রী ও ছেলের অবস্থা সঙ্কটজনক। না বাঁচার আশঙ্কাই বেশি।’’ বুধবার সকালে হাসপাতাল থেকেই বিমানবন্দরে যান পদ্মনাভবাবু। নুরবু হাসপাতাল থেকে পৌঁছে যায় দু’টি কফিন। সন্ধ্যা সওয়া সাতটায় পদ্মনাভবাবু কলকাতায় নামেন।

লেহ্ থেকে নুব্রার পথে যে রাস্তায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে, ওই তুষারপাতের পর থেকে রাস্তাটি মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত বন্ধ ছিল। জেলাশাসক সৌগতবাবু জানান, বুধবার সকালে সেই রাস্তা ফের খুলে দেওয়া হয় সাধারণ পর্যটকদের জন্য।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE